ভাস্কর্য ও মূর্তিঃ দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য বোঝা জরুরী

মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান
মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান

বাংলাদেশে অনেকবারই মৌলবাদীরা বিভিন্ন ভাস্কর্য ভেঙ্গে দেয়ার হুমকি বা ভাস্কর্য তৈরিতে বাধা প্রদান করেছে। ভেঙ্গেও দিয়েছে, এমনকি ছবি আঁকা ও মঙ্গল শোভাযাত্রার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

পয়লা বৈশাখ নববর্ষ পালনের বিরোধিতা করেছে। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে ফুল দেয়াকে বেদআত ঘোষণা করেছে এবং সকল শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলারও হুঙ্কার দিয়েছে। কিন্তু এর বিপক্ষে প্রতিবাদ হয়েছে দুর্বল।

কারণ গত প্রায় ৪০ বছরে মানুষের মননের জায়গাটা আলোকিত হওয়ার পরিবর্তে অন্ধকারাচ্ছন্ন হচ্ছে। এই অন্ধকার অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কোন উদ্যোগ প্রায় নেই। এই প্রেক্ষাপটেই ধোলাইখালে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরুদ্ধে চরমোনাই পীরের রণহুঙ্কার।

ভাস্কর্য আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান বা শিল্পের একটি অন্যতম শাখা। কোন মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা যে কোন কিছুরই প্রতিরূপ নির্মাণের দুটি মাধ্যম রয়েছে, একটি চিত্রকলা, অন্যটি ভাস্কর্য। রংতুলির মাধ্যমে চিত্র তৈরি হয়। আর সিমেন্ট, বালু, রড, পাথর, তামা, ব্রোঞ্চ প্রভৃতি দিয়ে তৈরি হয় ভাস্কর্য।

ভাস্কর্য মানুষের পূজার নিমিত্তে তৈরি হয় না। কিন্তু মূর্তি তৈরি হয় পূজার জন্য। পৃথিবীতে অসংখ্য ধর্মের মধ্যে পূজার প্রচলন রয়েছে। কিন্তু ইসলাম ঘোরতরভাবে মূর্তিপূজা বিরোধী।

কিন্তু যেহেতু ভাস্কর্য পূজার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয় না, তাই এর বিরুদ্ধে কারও আক্রোশ থাকার কথা নয়।

হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের সামনে লালন সাঁইয়ের ভাস্কর্য তৈরি করতে গেলে বাধা দেয়া হয়। সরকার তখন পিছু হটে। যারা ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে অন্দোলন করছেন তারা বুদ্ধিবৃত্তিক বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে দেখেননি।

পৃথিবীতে সব মানুষই বিশ্বাস থেকে ধর্ম পালন করে। এই বিশ্বাসের সবই অবস্তুগত। আল্লাহ, ফেরেশতা, বেহেশত, দোজখ, পাপ-পুণ্য সবই বিশ্বাসের আওতায়। আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং সর্বত্র বিরাজমান এই বিশ্বাস থেকে আমরা তাঁর উপাসনা করি।

যখন কোন শিল্পী কোন ভাস্কর্য তৈরি করেন তিনি কোন প্রার্থনার জন্য তা করেন না। এখানে শিল্পীর মানসিক অবস্থান ও বিশ্বাসই বড় কথা। অন্য কেউ ভাস্কর্যকে মূর্তি বললে হবে না।

আমি রোজা রাখলে অন্য কেউ যদি আমাকে বলেন, আমি না খেয়ে আছি, তাহলে তো সঠিক হবে না। কারণ এখানে আমার বিশ্বাস বা মানসিক অবস্থানই (নিয়ত) গুরুত্বপূর্ণ।

পৃথিবীতে জ্ঞান বা শিল্প জগতে ভাস্কর্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।

বাংলাদেশের ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো এক সময়ে ইরানকেই আদর্শ হিসেবে মনে করত। আয়াতুল্লাহ্ খোমেনীর ছবি ধারণ করে তারা রাস্তায় মিছিল করত।

১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ্ খোমেনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হলেও ইরানের বিখ্যাত মনীষীদের ভাস্কর্যকে তারা ধ্বংস করেনি।

কবি ফেরদৌসী, শেখ সাদী, ওমর খৈয়াম, ইবনে সিনা, আল বিরুনী প্রভৃতি পৃথিবী বিখ্যাত মানুষের ভাস্কর্য এখনও ইরানের রাস্তায় শোভা পায়।

তেহরানের ফেরদৌসি স্কোয়ারে প্রায় ১০ফুট উচ্চতায় মহাকবি ফেরদৌসীর ভাস্কর্য, তেহরানের লালেহ্ পার্কে রয়েছে ওমর খৈয়ামের ভাস্কর্য, এটি ৬ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট।

আর ইবনে সিনার ভাস্কর্য রয়েছে হামাদানে। এমনকি প্রাচীন পারস্যের রাজা ইয়াকুবের ভাস্কর্য রয়েছে ইরানে। বাংলাদেশের অনেকেই আজকাল তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানকে মুসলিম বিশ্বের ত্রাণকর্তা মনে করেন।

তিনি সম্প্রতি আয়া সোফিয়ার গির্জাকে মসজিদে রূপান্তরের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু মোস্তাফা কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্যকে ধ্বংস করেননি। এতে ইরান বা তুরস্কের মানুষের ধর্ম পালনে কোন বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে না।

তুরস্কে সুলতান ফাতিহ মাহমুদের ভাস্কর্য এখনও দণ্ডায়মান। পাকিস্তানের করাচী বিমানবন্দরে অবতরণের পরই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বিরাটাকায় ছবি সেখানকার মুসলমানদের ইমান-আকিদা নষ্ট করেছে বলে শোনা যায় না।

আসলে যারা ভাস্কর্যের, বিশেষ করে হঠাৎ করে ধোলাইখালে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করছেন তারা প্রকৃতপক্ষে ধর্মের লেবাসে রাজনীতি করছেন।

ইসলাম ধর্মের অনেক বিষয়কে মৌলবাদী রাজনীতিকরা নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করেন। শামসুর রাহমানকে এক সময় তারা মুরতাদ বলে ঘোষণা করেন।

অথচ আল মাহমুদ কবিতায় অনেক অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করলেও তাকে তারা বরণ করেছেন।

কোন মানুষ যখন যুক্তিকে হারিয়ে ফেলে, তখন তার পেশী শক্তি উদ্যত হয়। ভাস্কর্য ভাঙ্গার হুমকি এরই প্রকাশ।

মহানবী (সা) ইসলামের প্রারম্ভে কবিতা লেখা নিষিদ্ধ করেছিলেন। পরে আবার কবিতা লেখাকে ইতিবাচকভাবে নেন। তিনি ক’ব ইবনে যুহায়রকে উন্নত মানের কবিতা লেখার জন্য গায়ের চাদর উপহার দেন।

মহানবী (সা)-এর মৃত্যুর পরে বিবি ফাতেমাও কবিতা লিখেছেন। (দ্রষ্টব্য : আ ত ম মুছলেহ্উদ্দীন, আরবী সাহিত্যের ইতিহাস, ঢাকা : ইসলামী ফাউন্ডেশন, ১৯৮২, পৃঃ ১৫০-১৫২)।

মক্কা বিজয়কালে কাবাঘরের মূর্তিগুলোকে ভাঙ্গা হয়। কারণ, সেগুলো উপাসনার নিমিত্তে রক্ষিত ছিল।

এই মূর্তি ভাঙ্গার সময়ে এখানকার দেয়াল ও স্তম্ভে কিছু চিত্রাঙ্কিত ছিল। বিজয়ী সৈন্যরা এগুলো মুছে ফেলতে শুরু করলে মহানবী (সা) মেরীর কোলে শিশুর ছবিটিকে মুছতে দেননি।

এ ঘটনাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। মহানবী (সা) নারী ও শিশুর প্রতি সর্বদা সংবেদনশীল ছিলেন অথবা ছবিকে তিনি ছবি হিসেবেই দেখেছেন।

মহানবীর (সা) সময়ে যেহেতু মূর্তিপূজা আরব সমাজে প্রচলিত ছিল, আর মূর্তিকে পূজা করার অর্থ আল্লাহর অংশীদার তৈরি করা, তাই তিনি এটাকে নিষিদ্ধ করেছেন।

কিন্তু ভাস্কর্য যেহেতু উপাসনার জন্য নয় তাই আল্লাহর অংশীদার বা শরিক করারও প্রশ্ন আসে না এখানে।

হযরত আয়েশার (রা) পুতুল খেলাকেও মহানবী (সা) নিষিদ্ধ করেননি। অতএব ইসলামের নামে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণে বাধা সৃষ্টি করা ধর্মীয় দৃষ্টি কোন থেকেই বাঞ্ছনীয় নয়।

কারণ, দেশে বঙ্গবন্ধুর যত ভাস্কর্য আছে সেগুলোকে কেউ পূজা করে না।

যে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছে তারা শহীদ মিনারে ফুল দেয়ারও বিরোধিতা করে। এক সময় তারা হুঙ্কার দিয়ে বলেছে, সকল শহীদ মিনার তারা গুঁড়িয়ে দেবে। কিন্তু পারেনি।

জাতীয় স্মৃতিসৌধও তারা গুঁড়িয়ে দিতে চায়। তারা বাংলা নববর্ষ পালনেরও বিরোধী। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে তারা নাজায়েজ বলে।

তা হলে তো ‘আল্লাহ্ আপনার মঙ্গল করুন’ বাক্যটাও বলা যায় না। মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানোকেও তারা নাজায়েজ বলে। প্রদীপ একটি প্রতীকী বিষয়।

অন্ধকারের পরিবর্তে সবার মধ্যে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটুক এটাই প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মূল কথা। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম এসেছে অন্ধকারের পরিবর্তে পৃথিবীকে আলোকিত করার জন্য।

শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ সবই বাঙালীর গৌরবের প্রতীক। বাংলাদেশের অহঙ্কারের প্রতীক। যারা বাংলাদেশ চায় না, তারা শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধ গুঁড়িয়ে দিতে উদ্যত।

যারা পয়লা বৈশাখের বিরোধিতা করে, তারা বাংলাদেশের আবহমান সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের বিরোধী।

অথচ সমগ্র বিশ্ববাসী বাঙালীর আবহমান সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে তারা সহ্য করতে পারে না। কারণ তারা এখনও বাংলাদেশ চায় না। বাংলাদেশকে তারা মেনে নিতে পারে না।

বাংলাদেশ নামটি তাদের পছন্দ নয়। বঙ্গবন্ধু যেহেতু বাংলাদেশ করেছেন, তাই তাঁর অস্তিত্বকে তারা ভয় পায়।

শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, ম্যুরাল, লালন সাঁইয়ের প্রতিকৃতি, হাছন রাজার গান, রবীন্দ্রনাথের শিল্প ও নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা তাদের পছন্দ নয়।

কারণ এ সবই অসাম্প্রদায়িক আবহমান বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে।

১৯৫২-তে বাংলাভাষার বিরোধীরা পরাজিত হয়েছে বলে শহীদ মিনার দেখলে তারা আতঙ্কিত হয়। ১৯৭১ এ পরাজিত হয়েছে বলে তারা স্মৃতিসৌধকে ভয় পায়।

আর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরও তিনি স্বমহিমায় বিরাজমান। সে কারণে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে।

ইসলাম সুন্দর ও নান্দনিকতার বিপক্ষে নয়। দামেস্ক মসজিদ ও কুসায়ের আমরা (জর্দান) ও কুব্বাতুস সাখরা (জেরুজালেমে) অভ্যন্তরের অলঙ্করণ এটি প্রমাণ করে। হযরত আয়েশার গৃহের পর্দায় জীবজন্তুর ছবি ছিল।

এতে নামাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে মহানবী (সা) এটি সরিয়ে ফেলতে বলেন। পরে এই ছবিযুক্ত কাপড় দিয়ে আয়েশা (রা) বসার কুশন বানিয়ে ছিলেন। এতে মহানবী (সা) আপত্তি করেননি (দ্রষ্টব্য : এবিএম হোসেন ইসলামী চিত্রকলা, ঢাকা; খান ব্রাদার্স, ২০০৪, পৃঃ ১৪)।

এতে তাঁর সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ ঘটেছে। সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা বিরোধী জঙ্গীগোষ্ঠী জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে স্তব্ধ করে দিতে চায়। ভাস্কর্য নন্দনতত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। চিত্রকলা, সঙ্গীত ও নৃত্যে যেমন নান্দনিকতা রয়েছে, ভাস্কর্যেও রয়েছে তেমনি সৌন্দর্য ও শিল্প।

এটাকে দেখতে হবে সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তাহলে এখানে আর শিরক বা গুনাহ্র বিষয়টি সামনে আসবে না।

মানুষের প্রয়োজনে যখন কেউ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের দ্বারস্থ হচ্ছে তখন লজ্জা বা সঙ্কোচের যেমন সেখানে কোন স্থান নেই, তেমনি ভাস্কর্য দেখে তাকে আল্লাহর শরিক ভাবারও আদৌ কোন কারণ নেই।

বরং যারা একটি শিল্পকর্মকে শিরকের পর্যায়ে নিয়ে যায়, তারাই ধর্মবিরোধী। কারণ মানুষকে তারা ভুল তথ্য ও ব্যাখ্যা দিয়ে এবং ধর্মের অপব্যাখ্যা করে উত্তেজিত করে থাকে।

কিন্তু এর বিপরীতে খুব দুর্বল প্রতিবাদ আমাদের হতাশ করে। কারণ, একাদিক্রমে বারো বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকেও আমরা ধর্মের আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি।

আমরা বরং হেফাজতীদের কথায় পাঠ্যপুস্তকে অনেক গল্প-কবিতাকে বাদ দিয়েছি। হেফাজতের সম্মেলনের পরপর জঙ্গীবাদী ও মৌলবাদী গোষ্ঠী আরও তৎপর হয়ে উঠেছে।

এই যোগসূত্র অনুধাবন করা জরুরী ও আবশ্যক। ভাস্কর্য নির্মাণের পাশাপাশি একটি আধুনিক, মননশীল ও সুরুচিসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলাও আবশ্যক।

তা না হলে তিলে তিলে নির্মাণ করা সব শিল্পকর্ম এক সময়ে প্রগতি বিরোধীরা ধ্বংসকরে নিঃশেষ করবে।

লেখক : উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়