‘হতাশাগ্রস্ত গ্র্যাজুয়েট নয়, কর্মক্ষম ও স্বনির্ভর মানুষ তৈরি করুন’

আমিনুল ইসলাম

বছর দুয়েক আগের কথা। এক মা আমাকে টেক্সট পাঠিয়েছেন। সেই মেসেজ এসছে আমার আদার বক্সে।

আমি মোটামুটি সব মেসেজ’ই পড়ি। হয়ত সেই অর্থে উত্তর দেয়া হয় না। তো, এই মা তার ছেলে’কে নিয়ে খুব’ই চিন্তিত। তিনি আমাকে লিখেছেন

– আমার ছেলেটা মাস্টার্স পাশ করে তিন বছর ধরে বসে আছে। চাকরি হচ্ছে না। সব সময় কেমন ঝিম ধরে বসে থাকে। কখন কি করে বসে, সব সময় একটা ভয়ের মাঝে থাকি। আপনি কি আমার ছেলেটার সঙ্গে একটু কথা বলবেন? ও আপনাকে অনেক পছন্দ করে।
আমি নানান কাজে ব্যস্ত থাকি। সেই অর্থে সময় বের করাই আমার জন্য কঠিন। এরপরও আমি এই ভদ্রমহিলার মেসেজের উত্তর দিয়েছি এবং তার ছেলের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি। মাঝে মাঝেই বার্তা দিতাম। দুই-একবার মেসেঞ্জারে কথাও বলেছি।

যতটা সম্ভব চেষ্টা করেছি বিদেশে পড়তে যাবার ব্যাপার তথ্য এবং অন্যান্য বিষয় গুলোতে সাহায্য করার। ছেলেটা এখন বিদেশে পড়াশুনা করছে। কতোটা পড়াশুনা করছে, সেটা বলা মুশকিল।

যা হয় আরকি। ভাগ্য পরিবর্তন করার জন্য’ই তো বেশিরভাগ মানুষ বিদেশে যায়। সেই হিসেবে ছেলেটা হোটেল-রেস্টুরেন্টে কাজ করে বিদেশে নিজের পড়াশুনার খরচ চালাতে পারছে। নিজের মতো চলতে পারছে। অন্তত ওই হতাশাটুকু নেই।

এই ছেলে সৌভাগ্যবান এই অর্থে- তার বাবা-মা দুইজন’ই চাকরি করে। ছেলের রেজাল্ট তেমন ভালো ছিল না। নিজের খরচেই পড়তে হতো বিদেশে। তারা বাবা-মা’র সামর্থ্য থাকাতে সে বিদেশে চলে আসতে পেরেছে।

সবার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। বিশেষ করে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে সব ছেলেমেয়েরা পড়ে, তাদের জন্য তো নিজ খরচে বিদেশে পড়তে যাওয়া খুবই কঠিন।

তাহলে কেন বছর বছর নতুন করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে?

শুনলাম গত মাসেই তিনটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি দেয়া হয়েছে। প্রতিটা জেলায় এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে আসলে ফায়দাটা কি হচ্ছে?

মাস্টার্স পাশ করে যদি চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভুগতে হয়; তাহলে এতো মাস্টার্স পাশ গ্রাজুয়েটের দরকার কেন?

আমি গত সপ্তাহেই এই দেশের একটা কারিগরি স্কুলে এক্সটার্নাল হিসেবে গিয়েছিলাম। ইউনিভার্সিটি’তে পড়াতে পড়াতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। একদম গ্রামের মাঝে কি চমৎকার কারিগরি স্কুল।

আমার সব সময়’ই মনে হতো, এই দেশে তো পড়াশুনা ফ্রি; সেটা স্কুলে হোক কিংবা ইউনিভার্সিটি। তাহলে ছেলে-মেয়েগুলো শুধু শুধু কেন কারিগরি স্কুলে গিয়ে পড়ে?

এইবার সুযোগ হওয়াতে জিজ্ঞেস করেছি। ওরা উত্তরে বলেছে

– শুধু শুধু এতো পড়াশুনা কেন করবো? যাদের খুব বেশি জানার দরকার, তারা ইউনিভার্সিটিতে যাবে। আমাদের কাজ দরকার। এই জন্য টেকনিক্যাল বিষয় শিখছি। যাতে কম বয়স থেকেই কাজে লেগে যেতে পারি।

গিয়ে দেখি অনেক মজার সব সাবজেক্ট। কেউ গাড়ি মেরামত করা শিখছে। কেউ রান্না করা শিখছে। কেউ চুল কাটা শিখছে। ইত্যাদি আরও অনেক কিছু।

এরা স্কুল পর্যায়েই এইসব শিখে। এরপর পাশ করে এইসব কাজে ঢুকে যায়। এরপর যদি কখনো মনে হয়- আরও বেশি পড়তে হবে; তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে।

আমাদের দেশে তো কোটি কোটি মানুষ। এদের অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যে কাজের জন্য যায়। শুধু মধ্যপ্রাচ্য কেন, ইউরোপ-আমেরিকায় থাকা বাংলাদেশিদের ৮৫ ভাগ’ই তো এইসব কাজ করছে।

দেশে যদি কেউ এইসব কাজ করতে নাও চায়; অন্তত বিদেশে এইসব কাজ সহজে পাওয়া যাবে; এই বিষয়টা মাথায় রেখেও তো স্কুল পর্যায় থেকেই এইসব শিক্ষা চালু করা উচিত।

আর আমরা কিনা জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় খুলছি।

এতো মাস্টার্স ডিগ্রিধারী দিয়ে আপনারা কি করবেন?

কিছু ভিসি তৈরি হয়। কেউ দশ টাকায় চপ খাওয়ায়, কেউ আবার বলে বসে- তোমাদের কিন্তু বিয়ে হবে না!

আর ছেলেপেলেগুলো মাস্টার্স পাশ করে ভাবে- আমি মাস্টার্স পাশ! আমাকে দিয়ে ছোট কাজ করা মানায় না!

ছোট কাজ করলে দেখা যাবে আত্মীয়-স্বজন বলে বসবে- ছেলেটা মাস্টার্স পাশ করে এইসব করছে! পুরো পড়াশুনাটাই মাটি!

কি দরকার তাহলে এতো এতো আত্মহত্যা প্রবণ মাস্টার্স পাশ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করার?

এর চাইতে বরং একদম স্কুল পর্যায় থেকে হাতে-কলমে যেই শিক্ষা পেলে ভবিষ্যতে নিজের এবং দেশের লাভ হবে; সেই শিক্ষা দিন। এতে করে তারা প্রথম থেকেই জানবে- এটা তাদের পেশা হতে যাচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে কাজ করতে গেলে অন্তত সঙ্কোচে ভুগবে না।

ছেলেপেলেগুলো মাস্টার্স পাশ করে ভালো চাকরি না পেয়ে একটা পুরো জীবন হতাশায় কাটিয়ে দেয়।

আপনারা মাস্টার্স ডিগ্রী দিচ্ছেন; সাথে দিয়ে দিচ্ছেন – “মাস্টার্স পাশ” স্ট্যাটাস! সেই সাথে যে “বেকার” স্ট্যাটাস এসেও ওদের কাঁধে জুড়ে বসছে, সেটা তো আর দেখছেন না।

একটা আত্মহত্যা প্রবণ, হতাশাগ্রস্ত গ্র্যাজুয়েট জাতি তৈরি করার চাইতে কর্মক্ষম, স্বনির্ভর মানুষ তৈরি করুন।

যে কোন কাজ করেও যে সফল হওয়া সম্ভব, এই কন্সেপ্ট’ই আমাদের নেই!

ফেসবুক থেকে