সেনাবাহিনী এবং পুলিশ প্রধানের পিএইচডিঃ কি চমৎকার ব্যাপার!

আমিনুল ইসলাম

আমিনুল ইসলামঃ বাহ, কি চমৎকার ব্যাপার- সেপার!

সেনাবাহিনীর প্রধান এবং পুলিশের প্রধান দুজন’ই সম্প্রতি পিএইচডি করেছেন!

কাল কিংবা পরশু’ই না পত্রিকায় পড়লাম দক্ষিণ এশিয়ায় জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং আবিস্কারে বাংলাদেশের অবস্থান সব চাইতে নিচে!

গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সঃ দক্ষিণ এশিয়াতে তলানিতে বাংলাদেশ

অর্থাৎ নেপাল-ভুটানও আমাদের চাইতে এগিয়ে!

আমি বিদেশে যে ইউনিভার্সিটি’তে পড়াই, সেটা এমন কোন বিশাল ইউনিভার্সিটি নয়। এমনকি কোন নামকরা ইউনিভার্সিটিও না।

তর্কের জন্য ধরে নিলাম এই ইউনিভার্সিটি’তে পুরো পৃথিবী থেকে যেই ছাত্র-ছাত্রী গুলো পড়তে আসে; তারাও খুব একটা ভালো না (যদিও আমি নিজে সেটা বিশ্বাস করি না। আমার ছাত্র-ছাত্রী’দের ছোট করে দেখার কোন সুযোগ আমার নেই। স্রেফ পুরো ব্যাপার’টা বুঝিয়ে বলার জন্য না হয় ধরে নিলাম)

তো, এখানে বাংলাদেশ থেকেও কিছু ছাত্র-ছাত্রী পড়তে আসে এবং এদের বেশির ভাগ’ই আসার পর প্রথম এক সেমিস্টার কিংবা এক বছর এখানকার পড়াশুনার সিস্টেম কেমন সেটা ধরতে কাটিয়ে দেয়।

আমি নিজে যখন ১৭ বছর আগে সুইডেনে পড়তে এসছিলাম; আমাকেও এর মাঝ দিয়ে যেতে হয়েছে।

এর কারন হচ্ছে- বাংলাদেশের পড়াশুনার মান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক’রা আসলে কি পড়ায় আর কি শেখায় সেটা কেবল সৃষ্টিকর্তাই ভালো বলতে পারবেন। অন্তত আমি আমার নিজের কথা বলতে পারি- পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি যা শিখেছি- আমার ধারণা সুইডেনে স্রেফ এক বছরে আমি তার চাইতে বেশি শিখেছি।

তো, আমার এখানকার এক ছাত্রী (আমার এই ছাত্রী’কে দেখলে’ই খুব গর্ব হয়। একা একটা মেয়ে বিদেশে এসে নিজের পড়াশুনার খরচ চালিয়ে, টিউশন ফী দিয়ে, কাজ করে, এরপর নিয়মিত ক্লাস করে; তাও আবার বাংলাদেশের জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি থেকে বাংলায় অনার্স-মাস্টার্স করে, এখানে এসে এমবিএ পড়াশুনা; এইসব কারনে এই মেয়েটাকে দেখলেই মনে হয়- মেয়েটা অন্তত যুদ্ধটা জারি রাখতে পেরেছে।)

তো, এই ছাত্রী’র দুই বছরের মাস্টার শেষ করতে আড়াই বছর লেগেছে। কারন হচ্ছে- প্রথমবার সে মাস্টার্স থিসিসে পাশ করতে পারেনি। তাকে যেতে হয়েছে এক কঠিন সময়ের মাঝ দিয়ে। যা হোক, শেষমেশ সে পাশ করতে পেরেছে।

সে কতো টুকু শিখতে পেরেছে, সেটা আমি জানি না। এমন না আমাদের ইউনিভার্সিটি বিরাট ভালো কিছু শিক্ষা দিচ্ছে ছাত্র-ছাত্রী’দের। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি- এই ছাত্রী সাধারণ গবেষণা কিভাবে করতে হয়, সেটা অন্তত শিখে ফেলেছে।

আমার বরাবর’ই এই ছাত্রী’কে চমৎকার মনে হয়েছে। বেশ ভালো ছাত্র মনে হয়েছে। এই মেয়ে মাঝে মাঝে’ই আমাকে জিজ্ঞেস করে

-স্যার, আমাকে দিয়ে কিছু হবে?

আমি ওর প্রশ্ন শুনে হাসি। কারন আমি জানি, জগতের সবাইকে দিয়ে’ই কিছু না কিছু হবে। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। আর এই মেয়ে তো ভাগ্যবান, দেশ বিদেশের ডিগ্রী নিয়ে ফেলেছে। সেই সঙ্গে নিজের পড়াশুনার সুবাদে এখানে পার্মানেন্ট ভাবে থাকার সুযোগ পাচ্ছে। এমনকি জামাইকেও এখানে নিয়ে আসতে পেরেছে। তো, আমি মেয়টাকে বলেছিলাম

– এই যে তুমি এতো কিছু করে ফেলেছ; কয়টা মেয়ে’ই বা এটা পারে। তবে তোমার উচিত হবে না গবেষণা কিংবা এই লাইনে যাওয়া। আমার ধারণা তুমি স্কুল- কলেজে’র শিক্ষক হিসেবে বেশ ভালো করবে কিংবা যে কোন কেয়ার হোম বা এই ধরনের কোন চাকরি।

আরেক ছাত্র; এই ছাত্রের অবশ্য দুই বছরের মাস্টার্স শেষ করতে লেগে গিয়েছে প্রায় চার বছর। সকল কোর্স পাশ করে বসে আছে দেড় বছরেই কিন্তু থিসিস শেষ করতে পারছে না!

সেই থিসিস শেষ করতে তার প্রায় চার বছর লেগে গিয়েছে। সত্যি বলতে কি, এই ছেলে থিসিস ডিফেন্স করার পর যখন রেজাল্ট পেয়েছে; আমি দুই রাকাত নফল নামাজ পড়েছি নিজ থেকে। বছর দুইয়েক আগে কোন এক কারনে আমি ঠিক করে রেখেছিলাম- এই ছেলে পাশ করলে নিজ থেকে’ই নফল নামাজ পড়বো।

এই ছেলেও পাশ করার পড়ার জিজ্ঞেস করছিল

– কি করা যায়।

আমি সোজা বলে দিয়েছি- ফারদার পড়াশুনার দরকার নেই। Thats not you, Try something else. আরও অনেক জায়গা আছে, যেখানে তুমি ভালো করতে পারবে। সে সব দিকে চেষ্টা করা’ই ভালো হবে।

আমি’ই যে ঠিক বলছি, ব্যাপারটা এমনও না। ভুলও হতে পারি। আমি স্রেফ আমার ধারণা থেকে বলেছি।

যা হোক- তাই বলে কি এই ছেলে কিছু শিখেনি? আমি বুকে হাত রেখে, হলফ করে বলতে পারব- এই ছেলেও গবেষণা পদ্ধতি’র সকল বেসিক জিনিস শিখেছে এবং খুব জটিল না হলেও, সাধারণ ছোট খাটো গবেষণা হয়ত সে করতে পারবে।

কেন এই কথা বলতে পারছি জানেন?

কারন এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থাটাই এমন। আপনি মাস্টার্স থিসিস পাশ করে মাস্টার্স ডিগ্রী নেবেন; আর এইসব শিখবেন না; এটা হতেই পারে না। থিসিসের প্রী-ডিফেন্স আর ডিফেন্সে বসে থাকলে’ই আপনি অনেক কিছু শিখে ফেলবেন!

তো, আমার এই দুই বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রী’র কথা বলার কারন’টা হচ্ছে- এদের একজনের মাস্টার্স শেষ করতে আড়াই বছর লেগেছে। আরেকজনের প্রায় চার বছর লেগেছে স্রেফ সাধারণ কিছু শেখার জন্য, যাতে থিসিস’টা শেষ করে ডিগ্রী নেয়া যায়।

আর আমাদের সেনাবাহিনী প্রধান, পুলিশ প্রধান এমন দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকে; সকল কাজ করার পাশাপাশি পিএইচডি করে ফেলেছেন! কি চমৎকার ব্যাপার সেপার!

পিএইচডি’র মতো সময়সাপেক্ষ এবং এটি যে কি কষ্টের এবং গভীর একটা বিষয়; কেবল তারাই বলতে পারবে যারা এই ডিগ্রী’টা সত্যি সত্যি নিজদের আগ্রহে; গবেষণা করার ইচ্ছে এবং সঠিক জায়গায় সেটি করেছে। স্রেফ ডিগ্রী নেয়ার জন্য নয়!

অথচ আমাদের পুলিশ প্রধান, সেনাবাহিনী প্রধান দায়িত্বে থেকে মনের আনন্দে সেটি করে ফেলেছে! উনারা আসলে মহান এবং মেধাবী! নইলে কি করে এটা সম্ভব হলো, সেটাই তো বুঝতে পারছি না!

সেই সঙ্গে এই বিরল সাফল্য অর্জনের জন্য উনাদের সুপারভাইজার, যারা কিনা টেলিভিশনে টক’শো করার জন্য নিজেদের ইউনিভার্সিটি’তে যাওয়ার’ই খুব একটা সুযোগ পান’না; তাদেরও অভিনন্দন। তারা যে সময় করে এই দুই প্রধান’কে সুপারভাইজ করেছেন; সেটা ভেবে’ই মোহিত হচ্ছি!

আপনারা আসলেই অনেক মেধাবী। মাঝখান থেকে নেপাল-ভুটানও কেবল আমাদের চাইতে জ্ঞান- বিজ্ঞানে এগিয়ে গেল।

এ আর এমন কি। বাংলাদেশ পেছলে আপনাদের কি! আপনারা তো পিএইচডি ডিগ্রী নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন!

লেখকঃ শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, এস্তেনিয়া