শান্তির ধর্মে অশান্তির ফেরি করে তারা

ড. মো. আবদুর রহিম

ড. মো. আবদুর রহিমঃ ১৯৪৭ সালের দেশভাগের আগে-পরে পূর্ববাংলার হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছিল।

নিজ জন্মভূমিকে অনিরাপদ মনে হওয়ায় অনেকে দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। যারা পূর্বপুরুষের বসতভিটা, শ্মশানের স্মৃতি রক্ষার টানে মাটি আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করেন তাদেরও মনে শঙ্কা জাগে- মুসলিম রাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার নিয়ে বসবাস করতে পারবে তো!

যা হোক, ধর্মকে উপজীব্য করে পাকিস্তানি ধর্মান্ধতা আর অপরাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে নতুন করে প্রমাণ করতে হচ্ছে- ভাস্কর্য মানে মূর্তি নয়।

এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবে হিন্দুদের মনে ‘৪৭-এর শঙ্কা তৈরি করে- মূর্তির কী হবে তাহলে?

দেশভাগের পর ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী সীমান্ত গান্ধীখ্যাত খান আব্দুল গাফ্‌ফার খান একবার রাজশাহী শহরে এলেন।

স্থানীয় কংগ্রেস নেতা ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী সত্যেন্দ্রমোহন মৈত্রের বাড়িতে কংগ্রেসের হিন্দু নেতৃবৃন্দ সীমান্ত গান্ধীকে পূর্ববাংলার হিন্দুদের নাগরিক মর্যাদা নিয়ে শঙ্কার কথা জানান।

প্রসঙ্গক্রমে স্বাধীনতা সংগ্রামী বীরেন্দ্র সরকার প্রশ্ন করেন ‘এই ইসলামী রাষ্ট্রে আমরা হিন্দুরা কি থাকতে পারব’? উত্তরে খান আব্দুল গাফ্‌ফার খান বলেছিলেন, ইসলাম সব দেশের সব শ্রেণির লোকের মধ্যে শান্তির বাণীই প্রচার করেছে।

কিন্তু এক শ্রেণির স্বার্থান্ধ মানুষ তাদের নিজ মতলব ‘হাসিল’ করার জন্য অপব্যাখ্যা করে বিবাদ বাধায়।

মক্কা বিজয়ের পর নবী মুহাম্মদের (সা.) বিরোধিতাকারীরা পলায়নরত অবস্থায় ছিল। নবীজি (সা.) পরম মমতায় সবাইকে আশ্বস্ত করে ঘরে ফেরান।

মদিনা রাষ্ট্রেও তিনি সব সম্প্রদায়ের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন। ইসলামের সম্প্রসারণ ত্বরান্বিত হয় দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের (রা.) সময় থেকে। উমাইয়া ও আব্বাসীয় আমলে মুসলিম রাজত্ব এশিয়া ছাপিয়ে ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশে বিস্তৃত হয়।

পারস্য, রোমান-বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ও মিসরজুড়ে ছিল প্রাচীন শিল্পকলার উর্বর ক্ষেত্র। বলাই বাহুল্য, সেসব অঞ্চল ছিল ভাস্কর্য, মূর্তিসহ শিল্পকলার সব উপাদানে পরিপূর্ণ।

কোনো অভিযানেই সভ্যতার কোনো নিদর্শন ধ্বংস করা হয়নি।

ভারতবর্ষে সুলতানি ও মোগল যুগে কোনো শাসক ধর্মবিদ্বেষী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। মোগলদের পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্প-সাহিত্যে নতুন ঘরানার সৃষ্টি হয়।

ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে সুফি-দরবেশের আধ্যাত্মিক সাধনা ও প্রচারণায়। কোনো সুফি সাহিত্যে অন্য ধর্ম ও আচারের প্রতি কটাক্ষ করে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

বরং সুফিদের মানবতাবাদী দর্শনে আকৃষ্ট হয়ে হিন্দু ধর্ম সংস্কারক, দার্শনিক কবি এবং শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক সুফি সাধকদের সংস্পর্শে আসেন।

তাদের উভয়ের ধর্মদর্শন সুফি দর্শনের মানবতাবাদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়।

কেবল একাদশ শতকের প্রথমার্ধে গজনীর সুলতান কর্তৃক ১৭ বার ভারত আক্রমণের সময় বেশকিছু মন্দিরে আক্রমণের যে তথ্য পাওয়া যায়, তাও প্রতিমা ধ্বংসের জন্য নয়; মন্দিরে রক্ষিত স্বর্ণ-রৌপ্য পাওয়ার আশায়।

তিনি ভারতের সম্পদ দিয়ে গজনীকে সমৃদ্ধ নগরী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।

আব্বাসীয় খেলাফতের সময় বৌদ্ধিক বিকাশ উৎকর্ষের শীর্ষে পৌঁছেছিল। শিল্পকলা ও সাহিত্যের অগ্রগতি হয় ঈর্ষণীয়।

বাগদাদ নগরীর প্রতিষ্ঠাতা আল মনসুর তার প্রাসাদ গম্বুজের ওপরে এক অশ্বারোহীর মূর্তি স্থাপন করেছিলেন। টাইগ্রিস নদীতে খলিফা আল আমিনের যেসব বিলাসবহুল নৌকা ভেসে বেড়াত, সেগুলো সিংহ, ঈগল ও ডলফিনের আদলে তৈরি হয়েছিল।

আল মুকতাদিরের জলাশয়ের দু’দিকে কিংখাব পরা ও বর্শাধারী ১৫ জন অশ্বারোহীর মূর্তি তৈরি হয়েছিল, যাদের দেখে মনে হতো তারা যেন যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করছে।

সামাররা নগরের জনক খলিফা আল মুতাসিমের প্রাসাদের দেয়াল নারীমূর্তি ও শিকারের দৃশ্য দ্বারা সজ্জিত হয়েছিল। খলিফা আল মুতাওয়াক্কিলের ছবি আঁকা একটি রুপার মুদ্রা ভিয়েনার কনস্টিসটরসেজ মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে।

তুরস্কের মহান সুলতানদের সময়েও শিল্পকলা চরম উৎকর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। তুর্কিরা পারস্যের কাছেই শিল্পশৈলীর পাঠ গ্রহণ করেছিল। মিসরের অশিক্ষিত মামলুক সুলতানরাও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।

স্পেনের মুসলিম শাসনামলে মুসলমানদের উন্নত সভ্যতার প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপে আধুনিকতার সূচনা হয়। এভাবে মধ্যযুগের একটি উল্লেখযোগ্য সময় পর্যন্ত মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মনীষা সভ্যতার পথনির্দেশনা প্রদান করেছে।

পরবর্তী সময়ে ধর্মকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উপস্থাপনের মাধ্যমে উগ্র ধর্মতাত্ত্বিকরা মুসলিম সভ্যতার বিকাশ থামিয়ে দেয়। অথচ মুসলিমদের প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপ আজ আলোকপ্রভা ছড়াচ্ছে।

জ্ঞান-বিজ্ঞান আর শিক্ষার পথ হারিয়ে মুসলিমরা আজ নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। চার্চের অনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে এক সময়ের অন্ধকার ইউরোপ বৈষম্যহীন ‘ওয়েলফেয়ার সমাজ’ ব্যবস্থা কায়েম করতে সক্ষম হয়েছে।

অথচ আমাদের দেশ ভাস্কর্য কি মূর্তি, না নন্দন শিল্প- সেই বিতর্কে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। পৃথিবীর দেশে দেশে সবাই যখন গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে আবিস্কারের নেশায় ছুটে বেড়াচ্ছে, একবিংশ শতকে বিজ্ঞানের সেই চরম উন্নতির যুগে আমাদের দেশের কিছু ধর্মান্ধ মাওলানা ধর্মপ্রাণ সহজ-সরল মানুষকে চাঁদে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছবি দেখাচ্ছে!

খোদা-রাসুলের ইসলাম দুনিয়ার মানুষকে যুগে যুগে শান্তিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার সন্ধান দিয়েছে।

ইসলামের শান্তি, সংহতি, সমতা, সহমর্মিতা আর বিশ্বভ্রাতৃত্বের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাধারণ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে।

ভারতবর্ষের দিকে তাকালে দেখা যায়- ইসলাম ধর্মের ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার জাঠ মেঠ ইত্যাদি নিম্নবর্ণের হিন্দুরা।

ইসলামকে যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, এমন ভীতিকর চেহারা দেখলে তারা কি দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করত? ইসলামের শাশ্বত রূপই হলো অহিংস ও পরম তৃপ্তিদায়ক। আর বাংলার মানুষ তো চিরদিনই শান্তিপ্রিয়। সুফি ইসলামের প্রভাব তাদের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত।

রাজনৈতিক ইসলাম এখানে চলেনি কখনও। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এখানে পাকিস্তানি ধারার রাজনৈতিক ইসলামের কবর রচিত হয়েছে, যা পূর্ণতা পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানের মিলিত রক্তের স্রোতধারায়।

কাজেই ভাস্কর্য মূর্তি হোক বা না হোক; এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান খোদা-রাসূলের ইসলামকে ‘হেফাজত’ করবে চিরকাল; মসজিদে মসজিদে আজানের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হবে, সমগ্র মানবের মুক্তি কামনায় খোদার দরবারে নামাজির প্রার্থনার হাত উঠবেই।

মন্দিরে মন্দিরে পূজারির শঙ্খধ্বনি যেমন শোনা যাবে, গির্জার ঘণ্টাধ্বনি আর বিহারে প্রার্থনা সভাও অব্যাহত থাকবে এই বাংলায়। এখানকার অধিবাসীরা ধর্ম-মত-দর্শন নির্বিশেষে একসঙ্গে বাঁচবে।

বহুধাবিভক্ত ধর্ম-সংস্কৃতি, চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করে বাঙালি নৃতাত্ত্বিক একতাকে সবার ওপরে তুলে ধরবে।

লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]