বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের লড়াই

মেহেরপুরের মুজিবনগরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য। ছবি: প্রথম আলোর সৌজন্যে
আলমগীর শাহরিয়ার

পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল ধর্মের জিগির তুলে। সে রাষ্ট্র কাঠামোর অভ্যন্তরে একটি দল ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত তাদের কাউন্সিলে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ প্রত্যাহার করে নিয়ে সবাইকে চমকে দেয়।

কার্যত ধর্মপরিচয়ে বিভক্ত উপমহাদেশে নতুন ধারার রাজনীতির বার্তা দেয়। এমন সাহসী সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়েই মূলত আওয়ামী লীগ সর্বজনীন অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক একটি দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, মাওলানা আবদুর রহমান তর্কবাগীশের মতো উদার নেতৃত্বের পথ ধরে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির সূচনা করেন শেখ মুজিব। তিনি বুঝেছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের নামে আমাদের ধোঁকা দেওয়া হয়েছে।

তাই প্রয়োজন অনুভব করছিলেন একটি স্বতন্ত্র জাতির নতুন আত্মপরিচয় নির্মাণের। যেখানে সব ধর্ম, বর্ণ, মত, পথ ও বিশ্বাসের মানুষ শান্তি ও সহাবস্থানে থাকবে।

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শর্তও তাই। পাকিস্তান ছিল পশ্চাৎপদ চিন্তার একটি রাষ্ট্র। যে রাষ্ট্র সর্বজনের হয়ে উঠতে পারেনি।

শাসকশ্রেণি প্রথম সুযোগেই কেড়ে নিয়েছিল আমাদের মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা। চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল ভিনদেশি বুলি। কিন্তু, প্রতিবাদ করলো চিরকালের বৃত্তভাঙা উদ্যত সাহসী তরুণেরা। রাজপথে টগবগে তারুণ্যের বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়ে অসাম্প্রদায়িক একটি রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নের সূচনা হলো মাতৃভাষার প্রশ্নে আপসহীন থেকে।

যার স্বপ্নবীজ বুনলেন শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ষাটের সাহসী স্বাপ্নিক তরুণেরা। যারা চিন্তায় প্রাগ্রসর, আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক। মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে জান বাজি রাখতে প্রস্তুত তারা।

পৃথিবীজুড়ে দেশে দেশে দিকে দিকে মধ্যযুগীয় ধর্মাবরণ ও ঔপনিবেশিক শক্তির করতল থেকে বেরিয়ে দেশপ্রেমী জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থান হচ্ছে তখন। ধর্মের খোলসে মানুষকে বিভ্রান্ত করার রাজনীতি নয়, দরকার মানুষের প্রকৃত মুক্তির লড়াইয়ের রাজনীতি।

কিন্তু, তখনো প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর ধর্মের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনের অভীষ্ট লক্ষ্য ও স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখছেন, ‘দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের লোকেরা আরবি বলে।

পারস্যের লোকেরা ফার্সি বলে, তুরস্কের লোকেরা তুর্কি ভাষা বলে, ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কথা বলে, মালয়েশিয়ার লোকেরা মালয়া ভাষায় কথা বলে, চীনের মুসলমানেরা চীনা ভাষায় কথা বলে। এ সম্বন্ধে অনেক যুক্তিপূর্ণ কথা বলা চলে।

শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোঁকা দেওয়া যাবে ভেবেছিল, কিন্তু পারে নাই।’ (পৃষ্ঠা: ৯৮-৯৯)

উপমহাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের তাস খেলার প্রবণতা নতুন নয়। ভাষা আন্দোলনের অব্যবহিত পরেই ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহারের আরও নমুনা দেখতে পাই। শেখ মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মুসলীম লীগের ওয়াহিদ্দুজ্জামান।

তিনি যখন দেখলেন এই বেপরোয়া যুবকের সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন হবে, তখন অর্থের পাশাপাশি ধর্মাস্ত্র ব্যবহারে তৎপর হয়ে উঠলেন। বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘জামান সাহেব ও মুসলীম লীগ যখন দেখতে পারলেন তাদের অবস্থা ভালো না, তখন একটা দাবার ঘুঁটি চাললেন।

অনেক বড় বড় আলেম, পীর ও মওলানা সাহেবদের হাজির করলেন। গোপালগঞ্জে আমার নিজের ইউনিয়নে পূর্ব বাংলার এক বিখ্যাত আলেম মওলানা শামসুল হক সাহেব জন্মগ্রহণ করেছেন।

আমি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করতাম। তিনি ধর্ম সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন। আমার ধারণা ছিল, মওলানা সাহেব আমার বিরুদ্ধাচারণ করবেন না। কিন্তু এর মধ্যে তিনি মুসলীম লীগে যোগদান করলেন এবং আমার বিরুদ্ধে ইলেকশনে লেগে পড়লেন।

ঐ অঞ্চলের মুসলমান জনসাধারণ তাকে খুবই ভক্তি শ্রদ্ধা করত। মওলানা সাহেব ইউনিয়নের পর ইউনিয়ন স্পিডবোট নিয়ে ঘুরতে শুরু করলেন এবং এক ধর্ম সভা ডেকে ফতোয়া দিলেন আমার বিরুদ্ধে যে, “আমাকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে।”

সাথে শর্ষিনার পীর সাহেব, বরগুনার পীর সাহেব, শিবপুরের পীর সাহেব, রহমতপুরের পীর সাহেব সকলেই আমার বিরুদ্ধে নেমে পড়লেন এবং যত রকমের ফতোয়া দেওয়া যায় তাহা দিতে কৃপণতা করলেন না।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা: ২৫৬)

প্রবল ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈরিতা সত্ত্বেও সে নির্বাচনে শেখ মুজিব প্রায় দশ হাজার ভোটে জয় লাভ করেন।

হাজার বছরের গৌরবময় অধ্যায় একাত্তরে মুক্তি সংগ্রামের সময়ও দেখি ফের ধর্মের দোহাই তুলে পাকিস্তানের পক্ষে অনড় থাকে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। পাকিস্তানিদের দোসর সেজে যুদ্ধ করে স্বদেশের বিরুদ্ধে।

ভুলে যায় তারা দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। দেশ বলতে তারা বোঝে পাকিস্তান। পাক সেনাদের হাতে ধরিয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের। লুট করে মা-বোনের ইজ্জত। বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষদের।

এসবই তারা করেছিল ধর্মের নামে। বঙ্গবন্ধুর মতো শেখ হাসিনাকেও ধর্মের দোহাই তোলা রাজনীতির প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে বারবার।

সে ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে আপসহীন থাকা বঙ্গবন্ধুর জীবন ও যৌবনের সোনালি ফসল—সত্তর বছরের বেশি পুরনো দল—আওয়ামী লীগকেও অনেক আপস করতে হয়েছে।

সংগঠনকে ব্যক্তি জীবনের সঙ্গে তুলনা করলে একাত্তরের যে টগবগে তারুণ্যে ছিল, ২০২০ সালে সে বার্ধক্যে। অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ বার্ধক্যের যেমন সৌন্দর্য আছে, তেমনি সংকটও আছে। জরা আছে। ব্যাধি আছে।

আওয়ামী লীগেও তার চিহ্ন স্পষ্ট। ফলে উত্তরাধিকার সূত্রে রক্তে আওয়ামী বিদ্বেষ থাকা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর মুখপাত্র মামুনুল হক ‘বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ছুঁড়ে’ ফেলে দেওয়ার মতো চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের পরও দল থেকে ‘পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ’ সাপেক্ষ প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়!

এর প্রভাব কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ওপর পড়ে। সুদিনে দুধের মাছির মতো আওয়ামী লীগেও কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে গত এক দশকে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা প্রবল।

হেফাজত-জামাত-বিএনপি থেকেও এই রিক্রুটমেন্ট হয়েছে। যারা আদর্শিক প্রশ্নে আপসকামী ও নীতিহীন।

সংকটকালে আদর্শের প্রশ্নে এদের চরিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দলে অল্পবিস্তর নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের বিকাশ ঘটছে, কিন্তু এরা ষাটের দশকের সেই অসাম্প্রদায়িক নেতৃত্বের মতো আপসহীন হতে পারছেন কি?

না হলে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে পৌঁছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী— এদেশের জন্মলগ্ন থেকে যারা বিরোধিতা করে আসছে— তারা এত সাহস পায় কোথায়?

এদের লাগাম টানা ও রুখে দাঁড়ানো জরুরি। ভাস্কর্য মূল ইস্যু নয়, এদের বিরোধিতা মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে। ভাস্কর্য একটি উপলক্ষ্য মাত্র। পৃথিবীর সব মুসলিম দেশেই ভাস্কর্য আছে।

ভাস্কর্য একটি দেশ, নগর ও সভ্যতার স্মারক। এরাই বারবার এদেশের শিল্প-সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ করেছে। রমনার বটমূলে নৃশংস হামলা করেছে, লালনের ভাস্কর্য গুড়িয়ে দিয়েছে, ভিন্নমত পোষণকারী লেখকদের চরিত্র হনন করেছে, হত্যা করেছে।

আমরা জানি, জীবিত মুজিবও ওদের সহ্য হয়নি। জীবিত মুজিবের অসাম্প্রদায়িক ও দেশপ্রেমী রাজনীতির বিরুদ্ধে গিয়ে ধর্মের দোহাই তুলে এরা পাকিস্তান চেয়েছিল। এখন মৃত মুজিবও ওদের সহ্য হয় না। এখনো তারা দেশকে ব্যর্থ পাকিস্তান রাষ্ট্রের মতো বানাতে চায় মুজিবকে মুছে দিয়ে!

কিন্তু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মানে তো বাংলাদেশ। অবিনাশী এক নাম। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার সুবিশাল স্রোতস্বী প্রাণপ্রবাহী ধারার মতো সত্য। একটি জাতির মাটির ইতিহাস থেকে কোনোদিন মুছে দেওয়ার নয়।

লেখক: কবি ও গবেষক

[email protected]

(ক্যাম্পাস কানেক্টের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, ক্যাম্পাস কানেক্ট কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার ক্যাম্পাস কানেক্ট নিবে না।)