কী–বোর্ড গ্যাংস্টারদের জয়জয়কার কেন?

ড. হেলাল মহিউদ্দীন

‘কি-বোর্ড গ্যাংস্টারস’ শব্দটি প্রথম শুনি আমার এক ছাত্রের কাছে। ক্লাসে কিশোর অপরাধ সম্পর্কিত একটি আলোচনায় তিনি শব্দটির সঙ্গে পরিচয় ঘটালেন।

বিষয়টি সম্পর্কে জানার পরিধি বাড়াতে গিয়ে দেখলাম সমাজবিজ্ঞানীরা সারা বিশ্বেই এই বিষয়ে ভাবছেন, লেখালেখি করছেন এবং গ্যাংস্টারিজম কমাতে কাজও করছেন।

‘কি-বোর্ড গ্যাংস্টার’দের বিষয়ে অনেকগুলো সমাজ মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রবন্ধও পেলাম।

সেগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী, অনলাইনভিত্তিক মাস্তানিকে মোটাদাগে ‘কি-বোর্ড গ্যাংস্টারিজম’ বলা যায়। এটি সরাসরি অন্তর্জালনির্ভর অপরাধ নয়, তবে অনায়াসেই অপরাধী হওয়ার বাহন হয়ে উঠতে পারে।

ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি বা ব্যাংক ডাকাতি বা অন্যদের আর্থিক ক্ষতিসাধন গ্যাংস্টারদের উদ্দেশ্য নয়। অন্যদের মানসিক পীড়নেই তাদের বিকৃত আনন্দ। পীড়নের মূল বাহন ভাষা।

সাদামাটা সামাজিক জীবনে, এমনকি একান্ত বন্ধু সমাজেও যেসব ভাষার ব্যবহার নেই, সেসব ভাষাই কি-বোর্ড গ্যাংস্টারদের হাতিয়ার।

যা–ই হোক, আমার ব্যক্তিগত জানাজানি চেষ্টার একপর্যায় নিশ্চিত হলাম যে বাংলাদেশে এ–সংক্রান্ত কোনো আলোচনা শুরুই হয়নি এখনো।

সম্প্রতি ইপসস ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বব্যাপী ২২টি বড় দেশের ইন্টারনেটনির্ভর মনোপীড়নমূলক মাস্তানি বা সাইবার বুলিং নিয়ে গবেষণা করেছে। বিস্ময়কর বিষয় এই যে ভারত এই অপরাধে শীর্ষস্থান লাভ করেছে।

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একমাত্র ভারতকেই নমুনা ধরা হয়েছিল। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের স্বভাবও একই রকম বলে ভারতকে প্রতিনিধিত্বশীল নমুনা ধরা হয়। সেই অর্থে বাংলাদেশও ১ নম্বরে আছে।

ফেসবুকে কিশোর-কিশোরীদের সেই কয়েকটি দিনের উগ্র ও অশ্লীল মন্তব্যগুলোকে আমলে নিয়ে আমাদের কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে ভাবতে বসা দরকার। না হলে ভবিষ্যৎ দুর্যোগ এড়ানো কঠিন হবে।

বাংলাদেশও যে শীর্ষেই থাকতে পারে, সে রকম অনুমান করার অনেক কারণ রয়েছে। করোনার অভিঘাতে কিছুদিন আগে এইচএসসি পরীক্ষায় অটো পাসের ব্যবস্থা করা হয়।

স্বাভাবিকভাবেই ভালো ছাত্রছাত্রীদের জন্য সিদ্ধান্তটি ছিল নিদারুণ হতাশার। তাদের পড়াশোনা-প্রস্তুতি ভালো।

খুব ভালো পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফলাফল করে প্রতিযোগিতায় টিকে সগর্বে পছন্দের বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে—সিদ্ধান্তটি তাদের এই স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিল।

তাই একজন পরীক্ষার্থী সিদ্ধান্তটি চ্যালেঞ্জ করে আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়েছিল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য ফেসবুকে তাদেরই শ্রেণির তাদেরই বয়সী একদল কিশোর-কিশোরী অশ্রাব্য-অশ্লীল ভাষায় অস্ত্র শাণিয়ে তার বিরুদ্ধে হামলে পড়েছিল।

তাকে গণধর্ষণ করার মতো হুমকি দিতেও বাধেনি কারও কারও। বিস্ময়কর বিষয় এই যে তাতে সায়-সম্মতিও দিয়েছে একদল সমবয়সী কিশোরী। একসময় এই বয়সীদের বিপরীতে ‘কোমলমতি’ শব্দটি ব্যবহার করা হতো।

ফেসবুকে কিশোর-কিশোরীদের সেই কয়েকটি দিনের উগ্র ও অশ্লীল মন্তব্যগুলোকে আমলে নিয়ে আমাদের কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে ভাবতে বসা দরকার। না হলে ভবিষ্যৎ দুর্যোগ এড়ানো কঠিন হবে।

কি-বোর্ড গ্যাংস্টারিজমে বয়স্ক বা কিশোর-কিশোরী কেউই পিছিয়ে নেই। দুর্যোগ যে বাড়ছে এবং কি-বোর্ড গ্যাংস্টারিজমে বাংলাদেশ যে বিপজ্জনক অবস্থায় আছে, সামান্য চোখ-কান খোলা রাখলেই এই সত্যটি নজর এড়ায় না।

সম্প্রতি প্রথম আলো পত্রিকায় একটি খবর হয়েছে যে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের দুটি টেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে।

তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা অন্যের ফেসবুক আইডি নিজেদের দখলে নেয়, ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে, বিভিন্ন আইডির বিরুদ্ধে ফেসবুকে অসত্য রিপোর্ট করে।

যদিও সংগঠন দুটি দায় অস্বীকার করে জানিয়েছে যে তারা নিরাপদ অনলাইন ব্যবহার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অবস্থানে অনড় রয়েছে।

অন্যের চরিত্র হননে কি-বোর্ড গ্যাংস্টার এবং সাইবার বুলিংরা বিশেষ দক্ষ। এক কণা সত্যের সঙ্গে এক পাহাড় অসত্য মিলিয়ে চরিত্র হনন করেই তারা থামে না।

সচরাচর দ্রুততম গতিতে সেই সব রূপকথা অন্তর্জালে ছড়িয়েও দেয়। ন্যূনতম ভিন্ন ভাবনার মানুষের প্রতিও আক্রমণাত্মক হুমকি-খিস্তি চালিয়ে যাওয়া বুলিংদের আরেক কাজ। এ জন্য তারা নিত্যনতুন শব্দও উদ্ভাবন করে।

শুধু খেলাচ্ছলেই হুমকি–ধমকি, ভয়ভীতি দেখানো তাদের জন্য ডালভাত বিষয়। ফেসবুকে অনেকগুলো বানোয়াট পরিচয় (ফেইক আইডি) রাখা, অন্যদের অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে মিথ্যা রিপোর্ট করা, এমনকি পেশাদার হ্যাকার না হয়েও হ্যাকিংয়ের চেষ্টা করা, ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে অপরের অ্যাকাউন্টে গোয়েন্দা নজর রাখা ইত্যাদি কি-বোর্ড গ্যাংস্টারিজমের লক্ষণ।

এসবের চেয়েও বেশি সমস্যাজনক কি-বোর্ড গ্যাংস্টারিজমের মাধ্যমে কাউকে হীনমান-হতমান করে দেওয়া। সরাসরি অপমান করার চেয়ে অনলাইনে অপমান করতে পারার এবং বিপদে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ বেশি থাকায় এই অপরাধটি বাড়ছে।

বডি শেইমিং বা অন্যদের শরীরকে উপজীব্য করে মানসিক পীড়নও এর অন্তর্ভুক্ত।

‘কি-বোর্ড গ্যাংস্টার’দের স্বভাব সম্পর্কে সমাজ গবেষণাগুলোর ভাষ্য এই যে এরা সামনাসামনি নিরীহ ও ভদ্রলোক, দেখে মনে হবে ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না।

কী–বোর্ড গ্যাংস্টারদের জয়জয়কার কেন?

কিন্তু কি–বোর্ডের পেছনে বসলেই বাঘ-সিংহ। এদের মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা কম। সামনাসামনি আলোচনায় মত-প্রতিমত দেওয়ার সাহস বা আত্মবিশ্বাস কোনোটিই থাকে না তাদের।

সাহসের দিক থেকেও তারা পিছিয়ে পড়াদের দলভুক্ত। বেশির ভাগ সময় তারা ভালো মানুষ পরিচিতি নিয়েই অন্যদের সঙ্গে ভাব-খাতির জমিয়ে সংযুক্ত হয়।

অনেক সময় জনহিতকর কিছু করার ভেক ধরে। অনেক সময় বিভিন্ন অপরাধী চক্রের ক্রীড়নক হয়ে কাজ করে। যাদের মধ্যে আগ্রাসী ভাব থাকে এবং পাঠকের নজরে পড়ার গুণ থাকে, তাদের রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার মুখপাত্র হিসেবেও ব্যবহার করা হয়।

বাইরের জগতে আপাতনিরীহ পরিচয়ে পরিচিত ‘কি-বোর্ড গ্যাংস্টারস’রা একপর্যায়ে পেশাদার অপরাধ চক্রের ক্রীড়নকেও পরিণত হতে পারে।

অভিভাবকের ওপরেই বা কতটা ভরসা রাখা সম্ভব, যখন প্রাপ্তবয়স্করাই কি-বোর্ড গ্যাংস্টারিজমে জড়িত। পেশাদার সাইবার অপরাধীদের সিংহভাগই প্রাপ্তবয়স্ক। অনেকেই কোনো না কোনো কিশোর-কিশোরীর অভিভাবক।

তাঁরাই স্খলিত হলে সন্তানকে নৈতিকতা ও শুদ্ধতা শেখাবেন কোন মুখে?
এইচএসসির ছাত্রছাত্রীদের সেদিনের অশ্লীল ও অভব্য ভাষা-ব্যবহার দেখে ঔৎসুক্যবশত লিংক হতে লিংকে গিয়ে বেশ কিছু ফেসবুক অ্যাকাউন্টের পোস্ট পড়তে শুরু করি। অভিজ্ঞতাটি সুখকর নয়। মনে প্রশ্ন জেগেছে—কিশোর-কিশোরীদের অভিভাবকেরা কি সন্তানদের অনলাইন উপস্থিতির কিছুই জানেন না? জানলেও তাঁদের করার কিছুই কি নেই? অভিভাবকত্বের বাঁধন আলগা হতে হতে ছিন্নই হয়ে যাচ্ছে না তো? তাঁরা কি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছেও কোনো প্রতিবিধান বা সমাধান চাইতে আগ্রহী নন?

কারণ, এখনো পর্যন্ত সে রকম কোনো সামাজিক উদ্যোগের দেখা মেলেনি। অভিভাবকের ওপরেই বা কতটা ভরসা রাখা সম্ভব, যখন প্রাপ্তবয়স্করাই কি-বোর্ড গ্যাংস্টারিজমে জড়িত।

পেশাদার সাইবার অপরাধীদের সিংহভাগই প্রাপ্তবয়স্ক। অনেকেই কোনো না কোনো কিশোর-কিশোরীর অভিভাবক। তাঁরাই স্খলিত হলে সন্তানকে নৈতিকতা ও শুদ্ধতা শেখাবেন কোন মুখে?

দলীয় বিবেচনায় এই গ্যাংস্টারিজম আশকারা পায়। তাই ক্ষমতাশালীদের বিষয়ে কোনো ভাষ্যে নুন হতে চুন খসলেও যেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও পুরোনো আইসিটি আইনের খড়্গ নেমে আসে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতিকর ভাষিক নির্যাতনে জড়িতদের টিকিটিও ছোঁয়া হয় না। সামাজিক মাধ্যমকে অবলম্বন করে ব্যবহারকারীদের দুটি ভাগে ভাগ করে রাখার বেলায় গ্যাংস্টাররা দারুণ সফল।

বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুললেই নজর এড়ায় না যে কোনো মতামতধর্মী বিষয় নিয়ে কেউ দুকলম লিখলেই গ্যাংস্টাররা অশ্লীল, আপত্তিকর, উত্তেজক, উসকানি ও হুমকি-ধমকি দিতে হামলে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে রীতিমতো সংঘবদ্ধ হয় এই সব আক্রমণ। আক্রমণকারীরা যেন এই বিষয়ে প্রশিক্ষিত।

দেশীয় রাজনীতিসংক্রান্ত কোনো আলোচনায় এই আক্রমণ-প্রবণতা অনেক বেশি। কোনো আন্দোলন সৃষ্টির সম্ভাবনা সৃষ্টি হলে গ্যাংস্টারিজম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে।

শাহবাগ আন্দোলন থেকে শুরু করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটাবিরোধী আন্দোলন, রামপালে কয়লাবিদ্যুৎ উৎপাদনবিরোধী আন্দোলন ইত্যাদি সৃষ্টির কালে গ্যাংস্টারিজমের ব্যাপকতা নজরে এসেছিল।

কিন্তু সাধারণ যেকোনো সময়েও এই অনলাইনভিত্তিক আচরণ সমান সক্রিয়। এই সব কারণেই বাংলাদেশে কি-বোর্ড গ্যাংস্টারদের জয়জয়কার।

ইপসসের আগের অন্যান্য গবেষণায় জানা গিয়েছিল যে আত্মহত্যার প্রায় ৮ শতাংশ ঘটে সামনাসামনি বুলিংয়ের কারণে। আর সাইবার বুলিংয়ের কারণেও ১২ শতাংশই ঘটে।

অর্থাৎ সরাসরি পীড়নের চেয়ে অন্তর্জালভিত্তিক পীড়ন বেশি বিপজ্জনক। জাপানকে ‘আত্মহত্যার রাজধানী’ ধরনের দোষ দেওয়া হয়। কিন্তু লক্ষণীয়, জাপান বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘সাইবার বুলিং’মুক্ত দেশ হতে পেরেছে।

ইপসসের ২২টি দেশের মধ্যে জাপানই একমাত্র দেশ, যাদের সাইবার-বুলিং’জনিত আত্মহত্যা নেই। কারণ, জাপানের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি শিশু-কিশোরবান্ধব।

সব ধরনের উন্নয়ন চিন্তার শুরুই হয় শিশু-কিশোরদের কিসে ভালো হবে, না হবে—সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ দিয়ে। কি-বোর্ড গ্যাংস্টার ও সাইবার বুলিংদের হাত থেকে অন্তর্জাল জগৎকে মুক্ত রাখতে হলে বাংলাদেশকেও শিশু-কিশোরবান্ধব ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনার প্রাধান্যযুক্ত নীতিমালার কথা ভাবতে হবে।

লেখকঃ ড. হেলাল মহিউদ্দীন,  নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ এর অধ্যাপক।

ইমেইল [email protected]