বুদ্ধির খেলা বর্তমান মুসলিমরা কবে শিখবে?

মুসলিমদের নিয়ে একটি বড় সমস্যা হলো— তারা হেরে যাওয়ার জন্য কখনো প্রস্তুত থাকে না। তাদের সকল প্রস্তুতি বিজয়ী হওয়া নিয়ে। এটি যুদ্ধে হোক বা তর্কে হোক। এর কারণ সম্ভবত অহংকার, যদিও আল্লাহ অহংকারীদের পছন্দ করেন না, এরকম একটি কথা ইসলামে আছে। কিন্তু কথাটির প্রয়োগ, মুসলিমরা ধন-সম্পদ এবং পার্থিব অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে।

যেকোনো মূল্য জিততে হবে, এ মনোভাব মূলত পরাজিত মানুষের মনোভাব। যাদের জেতার সম্ভাবনা বেশি, তারা কখনো এ মনোভাব পোষণ করেন না। মুসলিমদের ইতিহাসেই এর প্রমাণ আছে। বদরের যুদ্ধে মুসলিমরা জয়ী হওয়ার জন্য যুদ্ধ করে নি, জিততেই হবে, এ মনোভাব তাদের মধ্যে ছিলো না। ফলে যুদ্ধের পরিকল্পনায় তারা বেশি সময় ব্যয় করেছিলো, এবং ব্যবহার করেছিলো বুদ্ধি। হামজা যদি রণকৌশল নিয়ে না ভেবে গোঁয়ারগিরি করতেন, তাহলে তারা যুদ্ধটিতে জিততো না।

কিন্তু দ্বিতীয় যুদ্ধটিতে তারা ধরেই নিয়েছিলো যে জিতবে, এবং তারা ছাড়া আর কেউ বিজয়ী হতে পারবে না, এরকম একটি অহংকার তাদের ঘিরে ধরেছিলো। ফলাফল— হেরে যাওয়া।

এর কারণ কী? এর কারণ হলো— অহংকার মানুষকে নির্বোধ করে তোলে। মানুষের মস্তিষ্কের যে-এলাকাগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ সম্পাদন করে, সে-এলাকাগুলো তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মানুষ শুধু প্রশংসাই শুনতে চায়। প্রশংসা হলো এক প্রকার ঘুমের বড়ি।

মুসলিমদের আত্মপ্রশংসা এখন এ ঘুমের বড়ির ভূমিকাই পালন করছে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তারা স্বপ্ন দেখছে— এই হবে সেই হবে।

ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে পাথর ছুঁড়ে ফিলিস্তিনিদের লড়াই
ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে পাথর ছুঁড়ে ফিলিস্তিনিদের লড়াই

ভালো চিন্তার জন্য ভালো ঘুম দরকার, কিন্তু ওই ঘুমের একটি নির্দিষ্ট সময় আছে। চব্বিশ ঘন্টার দিনে যে চব্বিশ ঘন্টাই ঘুমোয়, তার ধ্বংস অনিবার্য। ঘুমোতে হবে আট ঘন্টা, বা তার কাছাকাছি সময়। বাকি সময় কাজ করতে হবে। কাজ আর মোনাজাত এক জিনিস নয়। মোনাজাত করতে হবে কাজের ফাঁকে ফাঁকে।

এজন্য মাইক ভাড়া করার প্রয়োজন নেই। আল্লাহ বধির নন যে তিনি মাইকবিহীন মোনাজাত শোনেন না। বরং শশব্দ চিৎকারের চেয়ে, নিঃশব্দ চিৎকারেই আল্লাহ বেশি সাড়া দেন। কিন্তু কাজ না করে সারাক্ষণ চিৎকার করলে আল্লাহ সাড়া দেবেন বলে মনে হয় না। কেবল পর্যাপ্ত কাজ করলেই আল্লাহ সাড়া দিতে পারেন।

আক্কেলজ্ঞানের ব্যবহারও জানতে হবে। এ প্রসঙ্গে বেন গুরিয়ানের কথা মনে পড়ছে। বেন গুরিয়ান ছিলেন ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডি। ইসরায়েল যখন দাইমুনায় প্রথম পারমাণবিক রিয়েক্টর স্থাপন করে, তখন কেনেডি প্রশাসন সন্দেহ করে যে ইসরায়েল সম্ভবত পারমাণবিক অস্ত্র বানাবে।

এজন্য কেনেডি, বেন গুরিয়ানের উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেছিলেন যেন একটি মার্কিন পর্যবেক্ষক দল ইসরায়েলের পারমাণবিক স্থাপনা পরিদর্শন করতে পারে। আমেরিকা কিছুতেই চাচ্ছিলো না ইসরায়েল পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করুক।

বহু চাপাচাপির পর বেন গুরিয়ান কেনেডির প্রস্তাবে সাড়া দেন, এবং একটি মার্কিন পর্যবেক্ষক দল দাইমুনা প্রকল্প পরিদর্শন করে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি— দাইমুনা প্রকল্পটি ইসরায়েল বাস্তবায়ন করেছিলো ফ্রান্সের সহযোগিতায়, অত্যন্ত গোপনে। আমেরিকা ও ব্রিটেন এ ব্যাপারে কিছু জানতো না।

জেরুজালেম

মার্কিন পর্যবেক্ষক দল, দাইমুনা পরিদর্শন শেষে কেনেডিকে জানায়— রিয়েক্টরের ধরণ দেখে মনে হয়েছে যে তারা বোমা বানাবে না।

কিন্তু কেনেডির সন্দেহ থেকে যায়। এক পর্যায়ে কেনেডির সাথে নিউ ইয়র্কে বেন গুরিয়ানের সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়। বেন গুরিয়ান কেনেডিকে জানান— ‘আপাতত’ এ ধরণের কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই।

কিছুদিন পর সিআইএ কেনেডিকে একটি ইন্টেলিজেন্স এস্টিমেট দেয়। সিআইএ জানায়, দাইমুনায় ইসরায়েল প্লুটোনিয়াম উৎপাদন শুরু করেছে। এখনই থামানো না গেলে তারা মধ্যপ্রাচ্যকে অশান্ত করতে পারে। কেনেডি তখন বেন গুরিয়ানকে চাপ দেন যে, আমাদের আরেকটি পর্যবেক্ষক দল পাঠাতে হবে।

বেন গুরিয়ান সময় নেন, এবং প্রসঙ্গটি বারবার এড়িয়ে যেতে থাকেন। এ সময়ে মুসলিম নেতারা একটি আহাম্মকি করে বসলো। অবশ্য এ ধরণের আহাম্মকি তাদের নতুন নয়। ইসরায়েলের আশেপাশের দেশগুলো একটি যৌথ বিবৃতি (জয়েন্ট ডিক্লারেশন) সই করলো। বলা হলো_ ইসরায়েলকে আমরা উড়িয়ে দেবো। ফেসবুকের বাংলাভাষী মুসলিমরাও এখন এ ধরণের হুংকার দিয়ে থাকেন। কেন এতোগুলো মানুষকে উড়িয়ে দিতে হবে?

ম্যাপে ইসরায়েল, পশ্চিম তীর এবং গাজার অবস্থান
ম্যাপে ইসরায়েল, পশ্চিম তীর এবং গাজার অবস্থান

বেন গুরিয়ান এ সুযোগটিই নেন। তিনি কেনেডিকে চিঠি লিখেন— মিস্টার কেনেডি, আপনি কি চান আমরা আরেকবার হিটলারের হাতে পড়ি? আপনি কি দেখছেন না প্রতিদিন আরব নেতারা আমাদের উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে?

অবশ্য কেনেডি এ চিঠিকে গুরুত্ব দেন নি। কারণ এ ধরণের হুমকি আরব নেতারা এর আগেও দিয়েছে, কিন্তু কখনো ইসরায়েলকে উড়িয়ে দেয় নি। সিআইএ কেনেডিকে পরামর্শ দেয়— বেন গুরিয়ান প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করছে। আপনি প্রসঙ্গ পাল্টাবেন না। কেনেডি বেন গুরিয়ানকে লিখেন— আপনার আশংকা অমূলক। আমরা পর্যবেক্ষক দল পাঠাবো।

একদিন আবার মার্কিন পর্যবেক্ষক দল দাইমুনায় যায়। কিন্তু এ সময় দাইমুনা কর্তৃপক্ষ তাদের খুব একটা সহযোগিতা করে নি। মাত্র চল্লিশ মিনিট তাদের দাইমুনা পর্যবেক্ষণ করতে দেয়া হয়।

সিআইএ তখন আরেকটি ইন্টেলিজেন্স এস্টিমেট প্রকাশ করে, এবং বলে যে— ইসরায়েল সম্ভবত ৯০ কেজি প্লুটোনিয়াম উৎপাদন করেছে, যা দিয়ে ১০-১৫টি অস্ত্র বানানো যাবে। কেনেডি এ পর্যায়ে ইসরায়েল আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। দাইমুনায় বিমান হামলা চালানো যায় কি না তা ভেবে দেখতে পেন্টাগনকে নির্দেশ দেন।

কিন্তু মিশরের আহাম্মক জামাল আব্দুল নাসের থাকতে ইসরায়েলের চিন্তা কীসের? জামাল ছিলেন অবিকল আমাদের ফেসবুক মুসলিমদের মতো। ইহুদিদের পৃথিবী থেকে নির্মূল করতে হবে, এই ছিলো তাঁর রুটিন চিৎকার। জামালকে উদ্ধৃত করে বেন গুরিয়ান কেনেডিকে একটি আবেগঘন চিঠি লিখেন। তিনি জানান যে, জামালের হাবভাব সুবিধার নয়। তিনি জার্মান নাজি-সোশ্যালিজমে বিশ্বাস করেন।

যেকোনো সময় তিনি হিটলার হয়ে উঠতে পারেন, এবং তার এ মনোভাবের সাথে অধিকাংশ মুসলিম জনতা একমত পোষণ করেন। এটি আমাদের অস্তিত্বের জন্য ভয়াবহ হুমকি। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এই মুহুর্তে আমাদের একটি ‘ইনসুরেন্স পলিসি’ প্রয়োজন (আমার ধারণা এই ‘ইনসুরেন্স পলিসি’ শব্দরাশিটি দিয়ে বেন গুরিয়ান পারমাণবিক অস্ত্রের দিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন, এবং কেনেডি তা বুঝতে পেরেছিলেন)।

এ চিঠির পর কেনেডি প্রশাসনের মনোভাব পাল্টে যায়, কারণ কেনেডির কাছে জামালের ব্যাপারে যে-ইন্টেলিজেন্স ছিলো তা ভালো ছিলো না। জামালের কথাবার্তা হিটলারের কথাবার্তার মতো ছিলো, এটি কেনেডি প্রশাসনের সবাই জানতেন।

তারপরের অবস্থা আপনার সবাই জানেন। কিন্তু আমি কোনোদিন কোনো মুসলিমকে দেখি নি, জামালের সমালোচনা করতে। এখনও তাদের ভেতর যে-পরিমাণ ইহুদি-বিদ্বেষ, তাতে ইসরায়েলের সাথে ফিলিস্তিনের কোনো রাজনীতিক সমাধান সম্ভব নয়। তারা বিশ্বাস করে— ইহুদি কতল করা জায়েজ। আমি যদি বলি, ইহুদিরাও যদি ভাবে যে মুসলিম কতল করা জায়েজ, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? ভারতে ইতোমধ্যে হিন্দুদের ভেতর (সংখ্যায় খুব বেশি নয়) এরকম একটি মনোভাব কিন্তু এসে গেছে।

আর ধর্মীয় কারণে, ইহুদিদের মতো নিপীড়িত জাতি ইতিহাসে খুব বেশি নেই। এজন্য তারা সহজেই, এখন ফিলিস্তিনের একটি ঢিলকেও জাতিসংঘ সনদের আর্টিকেল ফিফটি ওয়ানের পরিপন্থী মনে করে, এবং বিশ্বনেতারাও এটি বিশ্বাস করে।

আর মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়াটাও প্রায় অসম্ভব। শিয়া সুন্নি ওয়াহাবি সালাফি আহমদিয়া কাদিয়ানি এতো ভাঙা হাড়ির টুকরো রেখে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়। তার উপর অধিকাংশ মুসলিমই গোঁড়া। তাদের তালগাছে অন্য কেউ ভাগ বসাতে পারে না। তাদের পড়াশোনোও খুব একপেশে। চিন্তার স্বাধীনতা নেই বললেই চলে। যাদের চিন্তা স্বাধীন নয়, তাদেরকে কখনোই কোনো ‘কমন কজ-এর ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব নয়। এরা নিজে লুঙ্গি পরবে না, কিন্তু অন্য কেউ লুঙ্গি পরলো কি না তা নিয়ে ঘুম হারাম করে দেবে, এবং প্রায়ই অন্যের লুঙ্গি উল্টাতে গিয়ে নিজের উল্টিয়ে ফেলবে।

আমি বহু লেখায়, ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনে সংগঠিত যুদ্ধাপরাধ এবং ক্রাইমস এগেইনশট হিউম্যানিটি নিয়ে আলোচনা করেছি। ছাত্র অবস্থায় বহু পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তরেও এ প্রসঙ্গ নিয়ে লিখেছি। দেখিয়েছি, কীভাবে ইসরায়েল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছে। জাতিসংঘের রেজুলিউশানগুলোকে কী কী উপায়ে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। এমন কি ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশানের আওতায়, ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাকের বিচার করা যায় কি না তাও আলোচনা করেছি (একই জুরিসডিকশানের আওতায় ইসরায়েল আইখম্যানের বিচার করেছিলো)। তাই এগুলো নিয়ে এখন আর কিছু লিখি না।

— মহিউদ্দিন মোহাম্মদ