নিরাপদ মাদ্রাসা চাই

তুরিন আফরোজ

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজঃ আমাদের দেশে মাদ্রাসায় শিশু বলাৎকার নিয়ে সামাজিক নিরবতা রয়েছে। এর অন্যতম কারণ ধর্মীয় শিক্ষাস্থান নিয়ে আমাদের মাঝে একটা শ্রদ্ধা এবং ভয় কাজ করে। তাই এই সব জায়গাতে এত অপরাধ হওয়ার পরেও আমরা চুপ থাকি।

সরকার উদাসীন থাকে। গণমাধ্যম উদাসীন থাকে। আলেম ওলেমারা ফতোয়া দেয় না।

মাদ্রাসায় শিশু বলাৎকার চলে আসছে বহুদিন ধরেই। পত্র পত্রিকার খবরে এ সমস্ত অভিযোগ উঠে আসছে অহরহ। প্রকৃত ঘটনার সংখ্যা নিঃসন্দেহে আরও বহুগুণ বেশি।

আমাদের মাদ্রাসার ছেলে শিশুরা তাদের ধর্ম শিক্ষকদের পাশবিক নির্যাতনে গুমড়ে কেঁদে মরছে। কেউ কেউ নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করছে। আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে।

তাদের অবিভাবকেরাও ধর্মগুরুর ফতোয়া থেকে বাঁচতে বা একঘরে হয়ে যাওয়ার ভয়ে মুখ খুলতে চাচ্ছে না। এই যে প্রদীপের নিচে অন্ধকার তা নিয়ে আমাদের সমাজে তেমন প্রতিবাদ হয়েছে কি?

আমাদের দেশে মাদ্রাসায় শিশু বলাৎকার নিয়ে সামাজিক নিরবতা রয়েছে। এর অন্যতম কারণ ধর্মীয় শিক্ষাস্থান নিয়ে আমাদের মাঝে একটা শ্রদ্ধা এবং ভয় কাজ করে। তাই এসব জায়গাতে এত অপরাধ হওয়ার পরেও আমরা চুপ থাকি। সরকার উদাসীন থাকে।

গণমাধ্যম উদাসীন থাকে। আলেম ওলেমারা ফতোয়া দেয় না। ওয়াজকারীদের গলা ফাটানো চিৎকারে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয় না। আমাদের সুশীলরা চুপ থাকে; সরকারবিরোধী আন্দোলনেও কেউ নামে না। মাদ্রাসার ছেলে শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে কেউ অনশন করে না।

আবার ওদিকে ইসলামি উগ্রপন্থীরা সমকামী অধিকার কর্মী জুলহাজ ও তনয়কে সমকামিতাকে সমর্থন করার কারণে জবাই করলেও আজ পর্যন্ত কোনো মাদ্রাসা শিক্ষকদের সমকামিতার জন্য তাদের হাতে প্রাণ হারাতে শোনা যায়নি।

ব্যাপারটা যেন এমন মাদ্রাসায় শিশু বলাৎকারের ঘটনা মোটেও ইসলাম পরিপন্থী নয় এবং এসব মেনে নেয়ার মাধ্যমেই আমাদের দেশ ও জাতির কৃচ্ছ সাধন হতে বাধ্য।

কিন্তু এই যে কোমলমতি শিশুরা মাদ্রাসা অর্থাৎ তার ইসলামি শিক্ষাপীঠে বলাৎকারের শিকার হচ্ছে তারা কি আমাদের সন্তান নয়? তাদের নিরাপত্তা দেয়া কি রাষ্ট্রের কাজ নয়?

আমাদের সমাজপতিরা কতদিন কর্ণকুম্ভের মতো ঘুমিয়ে থাকবে? আমাদের সমাজ কবে এই ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে?

ইসলামি শিক্ষার ছাউনীর আচ্ছাদনে থেকে মাদ্রাসা শিক্ষকরা কি এই ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড নির্দ্বিধায় চালিয়ে যাবে?

একই সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে আমাদের কি যথেষ্ট আইন রয়েছে এই সব শিশু বলাৎকারের বিরুদ্ধে জোড়ালো পদক্ষেপ নেয়ার?

বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোনো পুরুষ, নারী বা জন্তুর সঙ্গে, ‘প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সহবাস’ করে সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে ‘প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সহবাস’ বলতে কী বুঝানো হয়েছে?

এই আইনের ব্যাখ্যায় দুই রকমের যৌন সহবাস কে ‘প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সহবাস’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। একটি হচ্ছে, Sodomy বা পায়ুকাম। অন্যটি হচ্ছে, Bestiality বা পশ্বাচার (পশুর সঙ্গে যৌনসঙ্গম)।

মাদ্রাসায় শিশু বলাৎকার নিঃসন্দেহে Sodomy বা পায়ুকামের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু মাদ্রাসায় শিশু বলাৎকারের অপরাধটি আরও ব্যাপক। নির্যাতিত মাদ্রাসা ছাত্রটি কিন্তু স্বেচ্ছায় এই অপরাধটি করছে না।

তাকে পায়ুকাম করতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাহলে যে মাদ্রাসা শিক্ষক জোর করে পায়ুকাম করছে তার সর্বোচ্চ শাস্তি শুধু যাবজ্জীবন নয়, আরো বেশি হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

অনেকেই মাদ্রাসায় শিশু বলাৎকারকে ধর্ষণের মতো একটি অপরাধ বলে গণ্য করেন। এর মূল কারণ এখানে জোরপূর্বক যৌনসংগমের (হোক তা প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে) একটি ব্যাপার রয়েছে।

বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা অনুযায়ী নিম্নলিখিত পাঁচটির যে কোনো অবস্থায় পুরুষ লোক কোনো নারী বা স্ত্রী লোকের সঙ্গে যৌন সহবাস করলে সেটা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে-

১। স্ত্রীলোকটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে।

২। স্ত্রীলোকটির সম্মতি ব্যতীত।

৩। স্ত্রীলোকটির সম্মতি ক্রমেই, কিন্তু মৃত্যুর বা জখমের ভয়ভীতি দেখিয়ে সম্মতি আদায় করা হলে।

৪। স্ত্রীলোকটির সম্মতি ক্রমেই, কিন্তু পুরুষটি জানে যে সে স্ত্রী লোকটির স্বামী নয়। স্ত্রীলোকটি জানে পুরুষটি তার স্বামী, এ ভেবে স্ত্রীলোকটি ভুল করলে।

৫। স্ত্রীলোকটির সম্মতি ক্রমেই কিংবা সম্মতি ব্যতীত যদি স্ত্রীলোকটির বয়স ১৬ বছরের কম হয়।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী মাদ্রাসায় ছেলে শিশু বলাৎকারকে ধর্ষণ বলে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তাহলে উপায় কী?

২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোন নারী বা ‘শিশু’কে ধর্ষণ করেন, তা হলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।

এই আইনে ‘শিশু’দের কোনো লিঙ্গ ভাগ করা হয়নি৷ আইনের ধারা ২(ট) সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- ‘শিশু’ অর্থ অনধিক ১৬ বৎসর বয়সের কোনো ব্যক্তি। তাহলে দেখা যাচ্ছে মাদ্রাসায় ছেলে শিশু বলাৎকারকে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারা অনুযায়ী ধর্ষণ বলে প্রমাণ করা সম্ভব।

তবে এবার আমি প্রশ্ন রাখতে চাই একটু ভিন্ন জায়গায়। মাদ্রাসায় শিশু বলাৎকারের ঘটনা ঘটলে আইনের আওতায় অপরাধীদের এনে দণ্ড নিশ্চিত করা না হয় সম্ভব হল, কিন্তু মাদ্রাসায় বলাৎকারের বিষয়টিকে আমরা প্রতিরোধ কেন করতে পারি না?

আমাদের বাধাটা কোথায়? আমরা অপরাধ সংঘটনের পরই শুধু তৎপর হব কেন? তার আগে কি আমাদের করবার কিছুই নেই? মাদ্রাসাগুলোকে নজরদারি করবার কি কেউ নেই? নাকি আমরা আমাদের ছেলে শিশুদের বলাৎকার হওয়ার জন্যই মাদ্রাসাগুলোতে ভর্তি করিয়ে রাখি?

আর তারা নিরবে নিভৃতে বলাৎকারের শিকার হচ্ছে জেনেও না জানার ভান করি?

কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি অন্যতম বিভাগ। ২০১৫ সালে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরও গঠন করা হয়। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে সারা দেশে ৭৬১৮টি এমপিওভুক্ত মাদ্রাসায় মোট ১,৪৭,৮০০ জন শিক্ষক ও কর্মচারিকে প্রতি মাসে বেতন ও ভাতা দেয়া হচ্ছে।

আবার মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে সারা দেশে ১৫১৯টি এবতেদায়ী মাদ্রাসার প্রায় ৪,৫২৯ জন শিক্ষককে অনুদান দেয়া হচ্ছে। এই বিপুল সংখ্যক মাদ্রাসা, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের প্রশাসনিক এবং একাডেমিক বিষয়ে মনিটরিংয়ের সার্বিক দায়িত্ব মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের। এ অধিদপ্তরের প্রশাসনিক অধিক্ষেত্র সমগ্র বাংলাদশ।

এমপওিভুক্তকরণ, শিক্ষক এমপওিভুক্তকরণসহ মাদ্রাসা শিক্ষার একাডেমিক এবং কাঠামোগত উন্নয়নের ব্যাপারে মন্ত্রণালয়কে পরার্মশ দেয়া এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া এ অধিদপ্তরের প্রধান কাজ।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তারিখের স্মারক নং- শিম/শাঃ২৪/বিবিধ-২-৮/২০০৮(অংশ)/২৭৪ মোতাবেক মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মপরিধি ব্যাপৃত হয়েছে। তার অন্যতম তিনটি হল:

(ক) মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড তত্ত্বাবধায়ন; এবং

(খ) মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের শৃঙ্খলামূলক কার্যক্রম তত্ত্বাবধান; এবং

(গ) মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের নিয়োগ, বদলি, পদন্নোতি ও চাকরি সংক্রান্ত বিষয়াবলী তত্ত্বাবধান।

২০২০-২১ সালে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে ৮৩৪৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।

তাহলে আমার প্রশ্ন হল, এই বিপুল বাজেট যেই মাদ্রাসা শিশুদের শিক্ষার জন্য বরাদ্দ ও খরচ করা হচ্ছে, সেই মাদ্রাসায় আমাদের শিশুরা কতটা নিরাপদ? কেন তারা দিনের পর দিন বলাৎকারের শিকার হবে?

মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর কেন মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড তত্ত্বাবধান করতে ব্যর্থ হচ্ছে? কেন মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর আমাদের দেশের মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের শৃঙ্খলামূলক কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করতে পারছে না?

যদি মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের নিয়োগ, বদলি, পদন্নোতি ও চাকরি সংক্রান্ত বিষয়াবলী তত্ত্বাবধায়ন করার এখতিয়ার মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর রাখে তাহলে মাদ্রাসার কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের দ্বারা কেন আমাদের মাদ্রাসা-শিশুরা বলাৎকারের শিকার হবে?

জনগণের করের টাকায় মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর যেই বিপুল বাজেট বরাদ্দ পায়, সেই বাজেটের সুবিধা নিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারি কর্তৃক আমাদের শিশুদের বলাৎকারের বিরুদ্ধে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেবে না- এটা আমরা সহ্য করব না।

মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের জবাবদিহি জনগণের সামনে স্বচ্ছভাবে উপস্থাপন করা উচিত বলেই আমি মনে করি।

এছাড়া, মাদ্রাসা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য দেশের একমাত্র সরকারি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট হল ‘বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট’ (বিএমটিটিআই)।

এটি ১৯৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবসম্পদ তৈরির উদ্দেশ্যে এ ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে বিশেষভাবে মাদ্রাসা শিক্ষকদের এবং সাধারণভাবে দেশের স্কুল কলেজ শিক্ষকদের চাকরিপূর্ব ও চাকরিকালীন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

তারাই বা কী প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন? তাদের প্রশিক্ষণে কি বলাৎকার যে একটি দণ্ডনীয় অপরাধ তা শেখানো হয়? খুব জানতে ইচ্ছে করে।

তবে শেষ কথা, অনেক হয়েছে! এবার আমরা আমাদের মাদ্রাসার ছেলে শিশুদের জন্য নিরাপদ মাদ্রাসা চাই! মাদ্রাসায় ছেলে শিশু বলাৎকারের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতে চাই!

লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী