দখলদারিত্ব এবং লুট যাদের নেশা, তাদের মুখে মানবিকতার বাণী অস্বাভাবিক

মো: আদনান আরিফ সেলিম

ঔপনিবেশিক আগ্রাসন বোঝার জন্য গত ছয়মাসে আমি সবথেকে বেশি পড়ালেখা করেছি লাতিন আমেরিকা আর আফ্রিকার ইতিহাস নিয়ে। আর সেখান থেকে বুঝতে পারছি ধর্ম কিংবা অন্য যে কারণেই হোক ইউরোপের লোকজন কোনো জনপদ দখল করলে সেখানে খুন, ধর্ষণ আর সীমাহীন লুণ্ঠনের বাইরে কিছু করে নি।

ভারতের মাটিতে তারা সৈয়দ আমীরালি, অক্ষয় দৈত্য, মধুসূদন, বঙ্কিম চাটুজ্জে, রাম্মোহন, বিদ্দেসাগর, নোয়াবাব্দুল্লতিফ কিংবা কলকতার ঠাকুর পরিবারের পাশাপাশি এই জাতের অনেক পা-চাটা মাল জন্ম দিতে পেরেছিল। ফলে দীনবন্ধু মিত্রের মতো দুই একটা বেয়াড়া লোকের নীলদর্পণে ব্রিটিশদের কুকর্মের প্রতিবিম্ব সেভাবে পড়েনি। আর তাই সেখানে হানন পাচা, কেই পাচা আর উকা পাচা এক হয়ে গেছে।

আফ্রিকার ঘানার গোল্ডকোস্ট থেকে কুঁজকো কিংবা তেনোচ্ছেৎলান। ভারতের নানা স্থান আর অন্য প্রতিটি দখলকৃত ভূখণ্ড ইউরোপীয়দের নৃশংস আচরণ অনেকটা একইরকম। আমরা ইতিহাস পড়িনি বলে জানি না লাতিন আমেরিকার নানা দেশে ইউরোপীয় বর্বররা সোনার খনি আর রাবার বাগান দখলের জন্য কত মানুষ খুন করেছে ।

পর্তুগিজ জলদস্যুদের হিংস্রতার সঙ্গে আদিম সমাজের তুলনা করা কঠিন। স্প্যানিশ ইনকুইজিশন ধর্মের নামে যে বর্বরতা বিশ্বের নানা দখলকৃত অঞ্চলে চালিয়েছে তার তুলনায় ফিলিস্তিনে ইজরাইলের আগ্রাসন নেহায়েত নস্যি।

আজ যারা ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে ইজরাইল প্রতিষ্ঠা করেছে তারা এখানকার কেউ না। ভৌগেলিকভাবে ইউরোপপলাতক এই গোষ্ঠী তাদের আদিম হত্যাকারী রূপটা ভুলতে পারেনি। ফলে তারা একইরকম আদিম উন্মত্ততায় ভূমিদস্যুতা চালিয়ে যাচ্ছে মাইলের পর মাইল জায়গা দখল নিয়ে। অন্যদিকে যারা তাদের দখলদারিত্বের প্রতিবাদ করছে কিংবা বাধা দিচ্ছে তাদের খুন করছে অবলীলায়।

হামাসের রকেট হামলা সেখানে অযুহাত মাত্র। বিশ্বের বোকা মুসলিম সম্প্রদায়ের অনর্থক আবেগ আর হাত তুলে দোয়া করার বাইরে কিছুই করার নাই এটা তারা জানে। কারণ আরব বিশ্বের সব শাসক আজ তাদের হাতের পুতুল। তাদের কুকর্মের বিরুদ্ধে তুরস্ক আর ইরান এক হলেও পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারত। কিন্ত সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মক্কা-মদীনার দখলদার, হজ্জের ব্যাপারি সৌদি আরব।

তেল আবিবের ইহুদি আর তেল আমিরের সৌদি আরব মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে দখলদারিত্বের ইতিহাসে। খ্রিস্টানদের জন্য সর্বজাতীয় ভ্যাটিকান থাকলেও মুসলিম সম্প্রদায়ের পবিত্র আল আকসার দখল তেল আবিবের। তার বিপরীতে মক্কা আর মদীনাও হাতছাড়া হয়ে চলে গেছে তেল আমিরের দখলে, যা অবশ্যই ভিন্ন প্রসঙ্গ।

ভিন্ন ধর্মের মানুষ পরের কথা শুধু ক্যাথলিক প্রোটেস্ট্যান্ট দ্বন্দ্ব ধরে ইউরোপের দোপেয়েগুলো কতজনকে নির্মম নির্যাতন করে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছে তার হিসাব নাই। ওরা মানুষের মাংসে গরম লোহার ছ্যাঁকা দেওয়া, ইস্পাতের চিরুনি গিয়ে শরীরের মাংস-চামড়া খুলে ফেলা, হাত পা আগুণ লাগিয়ে ঝলসে দেওয়া, গুহ্যদ্বার-যোনিপথে ধাতব-কাষ্ঠল দণ্ড ঢুকিয়ে নির্যাতন, কিংবা পানিতে চুবিয়ে মারার মতো কুকর্ম করে গেছে অবলীলায়।

ভারত, পাকিস্তান কিংবা আমাদের দেশে পড়ানো ইতিহাসে ইউরোপের কয়েকজন রাজা রাজড়ার নাম মুখস্থ করলেই পাস জুটে যায়। ফলে তাদের এসব কুকর্মের কথা অন্য সবাই দূরে থাক ইতিহাসের লোকজনও জানতে পারে না। পাশাপাশি ওদের নৃসংসতা নিয়ে কথা বলার লোকও নাই যারা নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে এটা তুলে ধরতে পারে।

যখন ধর্মের কথা হয় তখন আপনি মুসলিম বলে আল আকসা আর বাবরি মসজিদে আক্রমণের প্রতিবাদ করেন। বাকিরা তখন চুপ থাকে। কিন্ত লুটেরা ইউরোপীয় সন্ত্রাসীরা ভারত, আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকার যে সর্বনাশ করেছে তার ক্ষতিপূরণ দাবি করার সুযোগ কোনোদিনই আসবে না এই হিন্দু, মুসলিম খ্রিস্টান বিভাজনের কারণে। আসলে ওরা এমনটাই চেয়েছিল যা আমরা করছি।

ভাস্কো নুনেজ দ্য ব্যালবোয়া, কলম্বাস, পিথিয়াস, বার্থালমিউ ডিয়াজ, ভাস্কো দা গামা, আমেরিগো ভেসপুচি, জন ক্যবট, ফার্দিনান্দ ম্যাগোলান, অ্যালভারো মেন্ডানা দ্য নেয়রা, লুই ভেইজ দ্য টরেসপেড্রো ফার্নান্ডেজ কুইরোস, ফ্রান্সিসকো পিজারো কিংবা গঞ্জালো পিজারোর মতো কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের নামটা আমরা জেনেছি ভৌগোলিক আবিষ্কারক হিসেবে।

তবে বিভিন্ন দখলকৃত ভূখণ্ডে ওদের কুকর্ম সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও জানতে দেওয়া হয়নি আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের।

পর্তুগালের একটি মুরগি খামারের মালিককে হত্যা করে ডিম ও মুরগি চুরির অপরাধে শাস্তি হয়েছিল ভাস্কো ডা গামার। পাশাপাশি সে একজন পোটেনশিয়াল রেপিস্ট। মদ খেয়ে শুঁড়িখানার বিল না দিয়ে মারপিট করা কিংবা মার খাওয়া ছিল তার নিত্যদিনের রুটিন। অথচ আমাদের আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছে এই বদলোককে মহান করে তুলছি। সে নাকি ভারত আবিষ্কার করেছে। আদতে একটা চোর সিঁদ কেটেছে। তারপর তারা দলে দলে ঢুকে চুরি করেছে।

এসব ইতিহাস মানলে চোরের সিঁদকাটাও মহান কাজ বলে গন্য হবে। নিজ এলাকায় সংঘাতের জের ধরে এক পরিবারের সবাইকে পুড়িয়ে মেরেছিল ফ্রান্সিসকো পিজারো এবং গঞ্জালো পিজারো। তারপর স্থানীয় আদালত বিচার করে ওদের মৃত্যুদণ্ড দেয়। ফেরারি আসামি দুই ভাই পালিয়ে যায় লাতিন আমেরিকাগামী কোনো একটা জাহাজে করে। পরে তাদের আমরা চিনেছি মহান ভৌগোলিক আবিষ্কারক নামে।

প্রত্নতত্ত্ব নিছক কয়েকটা পুরাতন ঘরবাড়ির ছবি দেখা নয়। তেমনি ইতিহাস শুধু রাজা রাজড়াদের গল্প নয়। এর বহুমাত্রিক দিক আছে। সেগুলোকে আমরা পড়ার এবং বোঝার চেষ্টা করি। তবেই সবরকম পরিস্থিতির বাস্তবতা বোঝার সুযোগ হবে।

অন্তত রাজা বাদশাহর নাম মুখস্থকারী যে নষ্ট ইতিহাসের রীতি আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে আপাতত সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করি।

মো: আদনান আরিফ সেলিম
মো: আদনান আরিফ সেলিম
সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।