অংশীদারিত্ব, ডিজিটাল সেবা ও ‘নগদ’

তানভীর এ মিশুক

পার্টনারশিপ বা অংশীদারিত্ব না থাকলে কোথায় চলে- অন্দরে, বাইরে কেউ কি একা সব করতে পারেন? কে কোথায় আছেন যে একা সব আবিস্কার করেছেন আর মানুষের জীবন বদলে দিয়েছেন? ডিজিটাল সেবার ক্ষেত্রে এই কথাটি যে কতটা সত্য, যারা এই খাতে কাজ করেন তারা ভালো করেই জানেন। নতুন উদ্ভাবন বা এর বিস্তার পুরোটাই নির্ভর করে আসলে অংশীদারিত্বের ওপর দাঁড়িয়ে। সত্যিকার অর্থে এটি ‘দশে মিলে করি কাজ’ প্রবাদটির বাস্তবিক উদাহরণ।

আমাদের ক্ষেত্রে অর্থাৎ মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস, যেটিকে মানুষ প্রচলিত অর্থে মোবাইল ব্যাংকিং বলছে, সেখানে অংশীদারিত্বের বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। মোবাইল ফোনটি হলো এই সেবার একমাত্র বাহন। মোবাইল অপারেটরদের নেটওয়ার্ক হলো চলার রাস্তা। একটা সময় তো পুরোপুরি মোবাইল নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভর করে চলেছে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলা এই খাতটি।

অ্যাপ অবশ্য এখন একটি জায়গা নিয়েছে; কিন্তু তাতেও মোবাইল নেটওয়ার্কের দাপট রয়েই গেছে। কারণ এখনও খুব কম মানুষ অ্যাপ দিয়ে সেবাটি নিচ্ছেন। সেবার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষকে সেবা পেতে ভরসা করতে হচ্ছে মোবাইল নেটওয়ার্কেই।

আমরা ‘নগদ’-এর পক্ষ থেকে মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তুলে আনার যে প্রচেষ্টা চলাচ্ছি, সেখানেও অংশীদারিত্বই আসলে সবচেয়ে বড় উপাদান। মোবাইল ফোন অপারেটরকে আমরা আরও কাছে টেনে নিয়েছি এবং অংশীদারির একটি বড় জায়গাও তাদের দিয়েছি। আমাদের আয়োজন আর তাদের সহযোগিতায় এখন যে কেউ যে কোনো সময় হাতের মোবাইল ফোন থেকে *১৬৭# ডায়াল করে আর্থিক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন।

চমকে দেওয়া এই উদ্ভাবনে অংশীদারিত্বই সত্যিকার অর্থে আসল ‘আবিস্কার’। মোবাইল ফোন আর ‘নগদ’-এর যৌথ পরিকল্পনা আর টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের বাতলে দেওয়া নির্দেশনা মেনেই *১৬৭# চলছে, যা এরই মধ্যে আর্থিক খাতে দেশের প্রধান উদ্ভাবন হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।

মুহূর্তের মধ্যে কেবল মোবাইল ফোনের কয়েকটি বাটন স্পর্শ করার মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খোলা আমাদের জানা মতে পৃথিবীর আর কোথাও নেই। *১৬৭# ডায়াল করার পর ‘নগদ’-এর দিক থেকে যে এসএমএস যাবে, সেখানে চার ডিজিটের একটি পিন সেট করে দিলেই হলো। পিনটি দু’বার সেট করতে হবে, আর খুলে যাবে ‘নগদ’ অ্যাকাউন্ট।

অ্যাকাউন্ট খোলার কাজটা এখন সত্যিই এমন সহজ। অথচ এ দেশেই একটি টেলিফোন সংযোগ পেতে ২৭ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। ২০০৩ সালের ২৩ জুন বিবিসিতে একটি খবর এসেছিল, যেখানে বলা হয় আমাদের পুরান ঢাকার মোহাম্মদ ইসমাইল নামের একজন ১৯৭৬ সালের মে মাসে তখনকার একটি টিঅ্যান্ডটি ফোনের জন্য আবেদন করে ২০০৩ সালে সংযোগ পেয়েছিলেন। খবরটা তখন আমাদের স্থানীয় অনেক সংবাদপত্রেও বেরিয়েছিল। সে সময়ের কথা বাদ দিয়ে যদি আমরা বর্তমানেও থাকি দেখব যে, ব্যাংকের একটা অ্যাকাউন্ট খুলতে আট থেকে দশ পৃষ্ঠার ফরম পূরণ করা বাধ্যতামূলক। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের অ্যাকাউন্ট খুলতেও দুই পৃষ্ঠার ফরম পূরণ করে কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হয়।

তখনই নতুন উদ্ভাবন নিয়ে বাজারে আসে ‘নগদ’। এর উদ্বোধনের সময়ই বাংলাদেশ ডিজিটাল কেওয়াইসির যুগে প্রবেশ করে, যেখানে কেবল জাতীয় পরিচয়পত্রের দুই দিকের ছবি তোলা এবং একটি সেলফি দিয়েই অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। সেই সময়ও আমাদের অনেক সমালোচনা সইতে হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এবং নীতিনির্ধারকদের ধন্যবাদ যে শুরু থেকেই তারা আমাদের উদ্ভাবনের প্রতি আস্থা রেখেছিলেন।

ডিজিটাল কেওয়াইসির সেই উদ্ভাবন একদিকে যেমন গ্রাহকদের দুর্ভোগ লাঘবে সহায়তা করেছে, তেমনি আমাদের ওপর নতুন দায়িত্বও কিন্তু তৈরি হয়েছে। ডিজিটাল কেওয়াইসি তো কেবল অ্যাপ যারা ব্যবহার করছেন তাদের জন্য; কিন্তু গ্রামের ক্ষেতখামারে কাজ করা বা জেলে-শ্রমিক যাদের হাতে স্মার্টফোন নেই তারা কি তবে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস সেবার বাইরে থাকবেন? তাহলে সে দেশে ডিজিটাল ডিভাইস আরও বাড়বে? মূলত প্রান্তিক পর্যায়ের গ্রাহকদের চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে খেতে আমরা একরকম তাড়নাও অনুভব করছিলাম। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই আমাদের এমন কিছু উদ্ভাবনের দিকে মনোযোগ দিতে হয়েছে, যার মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খোলার ঝামেলাকে সহজতর করা যায়। সত্যিকার অর্থে *১৬৭# হলো আমাদের দুশ্চিন্তা মুক্তির ফসল।

ডিজিটাল ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে গিয়ে আমরা জানি, সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের তথ্য মোবাইল ফোন অপারেটরের কাছেই আছে। একাধিকবার ভেরিফিকেশনের কারণে এই তথ্য অনেক বেশি নিরাপদও বটে, যা সরকার নানান কাজে বিভিন্ন সময় ব্যবহার করে থাকে। তা ছাড়া মোবাইল অপারেটরের গ্রাহকমাত্রই যেহেতু মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের সম্ভাব্য গ্রাহক, সুতরাং আমাদের জন্য এটি ছিল একটি সুযোগ। আর এর চেয়ে নিরাপদ তথ্য কে কোথায় পাবে, আমরা জানি না।

মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্ডাস্ট্রিতে গ্রাহক তথ্য সঠিক না হওয়ায় শুধু একটি অপারেটরেরই দেড় কোটি সংযোগ বাংলাদেশ ব্যাংক বন্ধ করতে বাধ্য করেছে। আমরা নিশ্চিন্তে বলতে পারি, ‘নগদ’ এমন সব প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রাহকদের পরিচয় নিশ্চিত করে তবেই অ্যাকাউন্ট খুলেছে যেখানে পরিচয় জালিয়াতির কারণে অন্তত অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার ঘটনা ঘটবে না।

ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক