“শিশুদের নোবেল” পেল বাংলাদেশের সাদাত রহমান

সাদাত রহমান

এবছর আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশের কিশোর সাদাত রহমান।

সাইবার বুলিং ও সাইবার অপরাধ থেকে শিশুদের সুরক্ষা নিয়ে কাজ করে ‘শিশুদের নোবেল’খ্যাত এই পুরস্কার জিতে নেয় নড়াইলের ১৭ বছরের এই কিশোর।

এএফপির খবরে এ তথ্য জানানো হয়।

সংগঠনটির ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, এ বছর ৪২টি দেশের ১৪২ জন প্রতিযোগীর মধ্যে এক্সপার্ট কমিটি সাদাতকে নির্বাচন করেছে।

আজ শুক্রবার নেদারল্যান্ডসে ছোট্ট পরিসরে আয়েজিত এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাকে পুরস্কৃত করা হয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে অনুষ্ঠানটি অনলাইনে সম্প্রচার করা হয়। ২০১৩ সালে এই পুরস্কার বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই আজ অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হয়ে সাদাতের হাতে পুরস্কার তুলে দেন।

সাদাতের সঙ্গে চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পাওয়া অন্য দুজন হলো মেক্সিকোর ইভান্না ওরতেজা সেরেট ও আয়ারল্যান্ডের সিয়েনা ক্যাস্টেলন। ওই পুরস্কারের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু গত ২৯ অক্টোবর চুড়ান্ত ওই তিন প্রতিযোগীর নাম ঘোষণা করেন।

২০০৫ সালে রোমে অনুষ্ঠিত নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীদের এক শীর্ষ সম্মেলন থেকে এই পুরস্কার চালু করে ‘কিডস-রাইটস’ নামের একটি সংগঠন। শিশুদের অধিকার উন্নয়ন ও নিরাপত্তায় অসাধারণ অবদানের জন্য প্রতিবছর আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়।

১২ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা ওই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। গত বছর সুইডেনের বিশ্বজুড়ে সাড়াজাগানো তরুণ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ ও ক্যামেরুনের ডিভিনা মালম যৌথভাবে মর্যাদাপূর্ণ ওই পুরস্কার পান। পরিবেশ আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখায় তাকে এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।

সাদাত রহমান
পুরষ্কার হাতে সাদাত রহমান

২০১৩ সালে এই পুরস্কার বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই পরের বছর জয় করেছিলেন নোবেল।

অনুষ্ঠানে পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতি জানিয়ে সাদাত রহমান বলেন, এটা আমার জন্য, বাংলাদেশের জন্য একটা সম্মান। আমি সত্যিই অভিভূত। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যভহার বেড়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারের অন্যতম একটা অংশ দেশের কিশোর-কিশোরীরা। কিন্তু তাদের নিরাপত্তা নিয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই।

আমরা একট দল সাইবার বুলিং মোকাবিলায় ‘সাইবার টিনস’ নামে অ্যাপটি তৈরি করি। সবার প্রচেষ্টায় আমরা এমন একটি কাজ করতে পেরেছি। এজন্য সবার কাছে কৃতজ্ঞতা। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় এই কাজ আমাদের সহজ করেছে।

বক্তব্য শেষে তার অনুভূতি জানতে চান অনুষ্ঠানের উপস্থাপক। এসময় তিনি সাদাতকে মালালা ইউসুফজাইয়ের মতো একজন যোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করেন।

১৭ বছর বয়সী সাদাত নড়াইল আবদুল হাই সিটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। সাদাত রহমান ও তার দল সাইবার বুলিং ও সাইবার ক্রাইম থেকে শিশু-কিশোরদের রক্ষায় নানা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

সাদাত সম্পর্কে কিডস রাইটসের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, সাদাত একজন ‘তরুণ চেঞ্জমেকার’ ও সমাজসংস্কারক। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে এক কিশোরীর (১৫) আত্মহত্যার পর কাজে নামে সাদাত। সে তার বন্ধুদের সহায়তায় ‘নড়াইল ভলেন্টিয়ারস’ নামের একটি সামাজিক সংগঠন শুরু করে। এই সংগঠন বেসরকারি সংস্থা একশনএইডের ‘ইয়ুথ ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ–২০১৯’–এ বিজয়ী হয়ে তহবিল পায়।

এই তহবিলের মাধ্যমে তারা ‘সাইবার টিনস’ মোবাইল অ্যাপ তৈরি করে। এই অ্যাপের মাধ্যমে কিশোর–কিশোরীরা জানতে পারে কীভাবে ইন্টারনেট দুনিয়ায় সুরক্ষিত থাকতে পারে।

প্রায় ১ হাজার ৮০০ কিশোর–কিশোরী এই অ্যাপ ব্যবহার করছে। এই অ্যাপের মাধ্যেম ৬০টির বেশি অভিযোগের মীমাংসা হয়েছে এবং ৮ জন সাইবার অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হয়েছে।

বর্তমানে সাদাত ‘সেফ ইন্টারনেট, সেফ টিনএজার’ নামের একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সে এবং তার বন্ধুরা ইন্টারনেট নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে স্কুলে স্কুলে সেমিনার–কর্মশালা করছে। তারা প্রতিটি স্কুলে ‘ডিজিটাল স্বাক্ষরতা ক্লাব’ প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে।

সাদাত রহমান জানায়, সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে পিরোজপুরের দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা তাকে নাড়া দেয়। দেশে এ ধরনের আরও ঘটনা ঘটছে।

এক হিসাবে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৪৯ শতাংশ কিশোর-কিশোরী এ রকম সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়। কিন্তু নিজেদের সমস্যা কাউকে বলতে পারে না তারা। পুলিশ তো দূরের কথা, অনেকেই নিজের মা-বাবাকেও এ ব্যাপারে কিছু জানায় না। শেষ পর্যন্ত অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

সাদাত বলছে, এ ধরনের উপলব্ধি থেকে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া শিশু-কিশোরদের সাহায্য করতে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সাইবার টিনসের যাত্রা শুরু গত বছর অক্টোবর মাসে। এই অ্যাপের মাধ্যমে ভুক্তভোগী কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যোগাযোগ সৃষ্টি করা হয়। প্রথমত, ভুক্তভোগীকে মানসিক সাপোর্ট দেওয়া হয়।

অভিযুক্তকেও নিবৃত্ত করার চেষ্টা করা হয়। তবে বিষয়টি অপরাধ পর্যায়ে পৌঁছালে পুলিশ বিভাগকে জানানো হয়। নড়াইলের জেলা প্রশাসক আনজুমান আরা ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিমউদ্দিনের সহযোগিতায় এই কার্যক্রম আরও গতিশীল হয়েছে।

পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিমউদ্দিন বলেন, ‘সাইবার বুলিংয়ের ঘটনা দেশে প্রায়ই ঘটে। নড়াইল জেলা পুলিশের সাইবার টিম ও সাদাত রহমানের সাইবার টিনস এটি প্রতিরোধে একসঙ্গে কাজ করছে। সাদাতের অ্যাপটির ধারণা বিশ্বব্যাপী সাইবার বুলিং কমিয়ে আনায় সাফল্য আসতে পারে।

আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কারের শীর্ষ তিনে উঠে আসার বিষয়ে সাদাত বলছিলেন, ‘আন্তর্জাতিক ওই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার পাওয়ার তালিকার শীর্ষে পৌঁছাব তা চিন্তাও করতে পারিনি। ওই পুরস্কার প্রদান কর্তৃপক্ষ কাজের ধরনটির প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে।

কারণ সাইবার বুলিং সমস্যাটি বিশ্বব্যাপী। তাই আমার চিন্তাটি বিশ্বসভায় স্থান করে নিতে পেরেছে।’ সাদাত দোয়া চেয়েছে সবার কাছে।

সাদাত জানায়, পুরস্কারের সঙ্গে পাওয়া ১ লাখ ইউরো এই প্রজেক্টে অ্যাপটির উন্নয়নে ব্যয় করার ইচ্ছা তার। আশা করছে এটি পুরো বিশ্বের জন্য একটি মডেল হবে।

এক নজরে পুরষ্কার

আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার এমন কিছু বালক-বালিকাকে প্রদান করা হয় যারা শিশু অধিকার আদায়ের লক্ষে সাহসিকতার সাথে লড়াই করে যাচ্ছে।

বিজয়ীরা বিশ্বব্যাপী নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হওয়া স্বত্বেও অসাধারণ প্রতিশ্রুতি দেখিয়েছে। এই পুরস্কারের উদ্দেশ্য শিশুদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম প্রদান করা যেখানে তারা নিজেদের ভাবনার কথা প্রকাশ করতে পারবে।

আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কারটি ২০০৫ সালে রোমের ক্যাপিটলে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ওয়ার্ল্ড সামিটে কিডস-রাইটস কর্তৃক চালু হয়। এরপর থেকে প্রতি বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীর মাধ্যমে পুরস্কারটি উপস্থাপিত হয়ে থাকে।

আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী বিশ্বের সংবাদ শিরোনামে পরিবর্তন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। যার ফলস্বরূপ, গত বছর বিজয়ীদের বার্তা প্রায় ১.২ বিলিয়ন মানুষের কাছে পৌঁছেছে।

প্রতি বছর আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার বিজয়ীকে সারাবিশ্ব থেকে প্রাপ্ত মনোনয়ন থেকে নির্বাচিত করা হয়। একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি প্রার্থীদের মূল্যায়ন করে থাকে এবং একটি নির্বাচিত তালিকা গঠন করে থাকে। বাছাইকৃত মনোনীত প্রার্থীদের কিডস-রাইটস পর্যালোচনা করে থাকে।

স্থান: নেদারল্যান্ডস

সুযোগ সুবিধাসমূহ

আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী বিশ্বের সংবাদ শিরোনামে পরিবর্তন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়
বিজয়ীরা নিজেদের ধারনা প্রকাশের জন্য একটি গবেষণা অনুদান এবং একটি বিশ্বব্যাপী প্ল্যাটফর্ম পাবে
আবেদনের যোগ্যতা
বয়সসীমাঃ ১২-১৮ বছর

  • বিশ্বের যেকোনো স্থান থেকে আবেদন করতে পারবে
  • শিশুটির নিজের এবং অন্যান্য শিশুদের অধিকারের জন্য লড়াই করার একটি পরিষ্কার ইতিহাস থাকতে হবে
  • বিদেশ ভ্রমণ এবং অন্যান্য মানুষের সাথে সহজভাবে যোগাযোগ রক্ষা করার ক্ষমতা থাকা

যেসকল স্থানের প্রার্থীদের জন্য প্রযোজ্য: সকলে আবেদন করতে পারবে

আবেদন পদ্ধতি

মনোনয়নকারী একটি শিশুকে মনোনয়নপত্র পূরণের মাধ্যমে মনোনয়ন দিতে পারবে।
মনোনয়নকারীরা কিডস-রাইটস ফাউন্ডেশনকে [email protected]
এ ইমেল করতে পারে
তাদের নিশ্চিত করে মনোনীতদের একটি কপি প্রেরণ করতে হবে যাতে তারা মনোনয়ন প্রক্রিয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কারের ব্যাপারে আপডেট রাখতে পারে।