বিদ্যুৎ ও ডেঙ্গু বিপর্যয়ঃ সতর্ক করা হয়েছিলো, সচেতন হয়েছিলেন কি?

আমি তখন ইঞ্জিনিয়ারিং সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। খুলনায়। ১৯৯২-৩ সাল হবে। সালটা মনে রাখবেন। পরে দরকার হবে।

খাই-দাই—ক্লাসে যাই। আড্ডা দেই। এরশাদ বিদায় হয়েছে। দেশে বড় কোন সমস্যা নাই। থাকলেও ফেইসবুক নাই বলে আওলা হাউ-কাউও নাই। আমরা ভালোই ছিলাম।

একদিন প্রফেসর এম নুরুল ইসলাম স্যার আসলেন বুয়েট থেকে। আমি কখনো তার নাম শুনি নাই। সেই প্রথম শুনলাম। বুয়েটের Chemical Engineering Department এর প্রফেসর ছিলেন। পরে বুয়েটেরই Institute of Appropriate Technology এর রিসার্চ প্রফেসর হয়েছিলেন। তিনি নাকি কি একটা রিসার্চ করেছেন তা আমাদের সংগে শেয়ার করবেন। ২য় বর্ষ মেকানিক্যাল আর ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সকল ছাত্রদের দুপুরের ভাত ঘুম বাদ দিয়ে গ্যালারী হলে থাকতে বলা হয়েছে। কিছুটা বিরক্তি আর কৌতুহল নিয়ে গেলাম। স্যার দুই ঘন্টা লেকচার দিলেন। তার রিসার্চের নাম Status Report on Energy Sector। এই রিসার্চ তিনি করেছেন ১৯৯০-৯১ সালে।

ফলাফল এক কথায় ভয়াবহ!

তিনি বুঝতে পেরেছেন এই ভাবে চললে ২০০৫ সাল নাগাদ দেশ বিরাট বিপদে পড়বে। বিদ্যুৎ অবস্থা ভয়াবহ হবে। দেশ অন্ধকার হয়ে যাবে। তিনি এই রিপোর্ট সেই সময়ের সরকারকে দেখিয়েছেন। দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কেউ পাত্তা দেয় নি। তাই তিনি নিজে প্রযুত্তি বোঝে এমন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘুরে ঘুরে ছাত্রদের আশু বিপদের কথা বোঝাতে চেষ্টা করছেন। আশা করছেন যুব শক্তি কিছু করবে। আমি তার দায়িত্ববোধ দেখে মুগ্থ হলাম। সৌম্য চেহারার এই মানুষটির মুখ আমার মনে গেঁথে রইলো। ঐ পর্যন্তই। আমরা তার লেকচার শেষে আর দশটা ক্লাসের মতো হাই তুলতে তুলতে যে যার ঘরে ফিরে গেলাম। কারন স্যারের কথা ঠিক আমাদেরও বিশ্বাস হলো না। কারণ সেই ১৯৯২-৯৩ সালে দেশের মানুষ লোড সেডিং যা অল্প-স্বল্প পায় তা দেখে আতংকিত হওয়ার কিছুই ছিল না।

তারপর অনেকগুলো বছর চলে গেল। ১৯৯৬ সালে সরকার চেঞ্জ হলো। ২০০১ সালে আরেকবার চেঞ্জ হলো। আমরা পাশ-টাশ করে বিয়ে-সাদী করে জাঁকিয়ে বসলাম। নুরুল স্যার, তার রিপোর্ট আর অনেক আগের এক দুপুরের ২ ঘন্টার ঘুম মিস করার কষ্টও ততদিনে ভুলে গেছি।

কিন্তু বিপদ আমাদের ভুলে যায় নি।

স্যারের বেঁধে দেওয়া ২০০৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় নি। আপনাদের অনুরোধ করবো ২০০২-৩ সাল থেকে টানা চলা সেই ভযাবহ বিদ্যুৎ বির্পযয়ের কথা স্মরণ করতে। ঢাকা শহরে ১ ঘন্টা বিদ্যুৎ…এক ঘন্টা অন্ধকার! এই ভাবে সারাদিন। ঢাকার বাইরের অবস্থা আরো ভয়াবহ। ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুৎ নাই। সন্ধ্যার পরে অফিস থেকে ফিরে আমি গরম আর মশায় বেআব্রু হয়ে বসে থাকি আর নুরুল স্যারের কথা স্মরণ করি। ১০ বছর আগে তিনি বলেছিলেন। আমরা কেউ শুনি নাই।

চার্জার ফ্যান কেনা হলো। আইপিএস লাগানো হলো। একটা ছোটখাটো জেনারেটরও কেনা হলো।

একদিন রাতে সব ফেইল করলো। সারাদিন বিদ্যুৎ ছিল না। জুলাইয়ের গরম। চার্জার ফ্যান আর আইপিএস চার্জ হবে কিভাবে? জেনারেটরের তেল শেষ। রাত দুইটা। তেল কেনার উপায় নাই। আমার তিন বছরের ছোট বাচ্চা। টপ ফ্লোরে থাকি। হাতে একটা পেপার নিয়ে তাকে বাতাস দিতে বসলাম। সেই বাতাসও আগুনের মতো গরম।

মনে হলো এই দেশে কোন সরকার নাই!

২০১৯ সাল। সারাদেশে ডেংগি মহামারী আকার ধারন করেছে। আমার হাতে ২০০৬ সালের একটা রিপোর্ট। তৈরি করেছিলেন আইসিডিডিআরবি’র রিসার্চার শাকিল মাহমুদ। শিরোনাম “Dengue: An Epidemic Is Largely a Failure in Public Health Administration! The Role of Dhaka City Corporation, DCC of Bangladesh”.

তার সেই ২০০৬ সালের রিপোর্ট পরিষ্কার বলেছে বাংলাদেশ কি ভয়াবহ ডেংগি মহামারীর দিকে এগিয়ে চলেছে। ২০০০ সালেই ৫,৫৫১ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং ৯৩ জন মারাও গিয়েছিলেন! ২০০১ সালে ১৪৩০ জন আক্রান্ত হন আর ৪৪ জন মৃত্যুবরণ করেন।

তিনি তার রিপোর্টে পরিষ্কার বলেছেন কারা দায়ী। অন্য সব দেশ এই বিপদ কিভাবে মোকাবেলা করেছে। এখন আমাদের কি কি করা উচিৎ।

আমি নিশ্চিত খুঁজলে এই রকম আরো অনেক রিপোর্টই পাওয়া যাবে। শুধু পাওয়া যাবে না..কি কি কাজ করা হয়েছে তার খতিয়ান।

২০০৬ সাল থেকে ২০১৯!!! তের বছর! এখন আর ‘চৌদ্দ দিন লাগবে মশার ঔষধ আনতে’ এই গল্প শুনিয়ে কি লাভ বলেন?

একা বিদেশে পড়ে আছি। ভাই-বোন…আত্মীয়-স্বজন..বন্ধু..তাদের সন্তান….ফোন করে আস্তে জিজ্ঞেস করি, “কেমন আছো?”। উত্তর না দেয়া পর্যন্ত দম বন্ধ করে থাকি। ভয় হয়। পত্রিকার কোন খবর পড়তে ইচ্ছে করে না।

আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করি…এইতো সেপ্টেম্বর সামনে। সিজন শেষ হয়ে যাবে আশা করি। এক বছরের জন্য মুক্তি। তারপর আবার জুলাই…আগষ্ট ২০২০….২১…২২…। তারপর হয়তো কিছু হবে…।

আমি মাঝে মাঝে ভাবি….আমরা এতোটা আত্ম-বিধ্বংসী হলাম কি করে? কেউ কি বাঁচতে পারছেন? যিনি প্রতিদিন গড়ে ১০ লক্ষ টাকা করে ঘুষ নিতেন? যার বাসা থেকে ৮০ লক্ষ টাকা জব্দ হলো? যাদের দায়িত্ব ছিল এই রিপোর্টগুলো পড়া…বিশ্লেষন করা….সেই মতে কাজ করা?

কেউ কি বাঁচতে পারছেন?😞

লেখাঃ সালাউদ্দিন শৈবাল

সংযুক্তি/

বাংলাদেশে যেভাবে এলো ডেঙ্গু

ডেঙ্গু শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার একাংশে এবার ডেঙ্গু জ্বর মহামারি আকার ধারণ করেছে। ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা জারি করেছে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এই ডেঙ্গু এলো কোত্থেকে?

স্প্যানিশ ডেঙ্গু শব্দ এ রোগের নামকরণ হয়। যার অর্থ হাড়ভাঙা জ্বর। তবে স্পেনে শব্দটি এসেছে পূর্ব আফ্রিকার সোহাইলি আদিবাসীদের কাছ থেকে। তাদের বিশ্বাস ছিল ‘খারাপ আত্মার সংস্পর্শে হাড়গোড় ভাঙার ব্যথাঅলা’ এ জ্বর হয়।

ইতিহাসে ডেঙ্গু মহামারীর প্রথম তথ্য জানা যায় চীনে। খ্রিস্টপূর্ব ২৬৫-৪২০ অব্দে জিন সাম্রাজ্যের সময় এ রোগের প্রাদুর্ভাবের কথা জানা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও ডেঙ্গু বিভিন্ন দেশে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে।

পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার প্রজাতির মশা রয়েছে। এদের মধ্যে এডিস এজিপ্টি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। যাকে আমরা এডিস মশা বলি। এই মশাই ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী। এধরনের মশা ডেঙ্গু ছাড়াও জিকা ও চিকনগুনিয়ার বাহক। পরিষ্কার পানিতে জন্ম নেয়া স্বল্পায়ুর মশাই মুর্তিমান আতংক হয়ে দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিটিউট এর (আইইডিসিআর)প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, ডেঙ্গু জ্বর রোগটি প্রথম ১৯৫২ সালে আফ্রিকাতে দেখা যায়। পরবর্তীতে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন- ভারত, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার এবং ইন্দোনেশিয়াতে এটি বিস্তার লাভ করে।

সরকারি হিসেবে বুধবার (৩১ জুলাই) পর্যন্ত চলতি বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে ১৭ হাজার ১৮৩ জন। এর মধ্যে নব্বই শতাংশই চলতি মাসে।

মহামারি এ রোগ বাংলাদেশে এবারই প্রথম নয়। এর শুরুটা হয়েছিল ১৯৬২ সালে। প্রথমে অবশ্য এই জ্বরটি ঢাকায় একসঙ্গে অনেকের হয়েছিল বলে এর হয়ে যায় ‘ঢাকা ফিভার’। তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এটি ডেঙ্গুজ্বর বলে শনাক্ত করেন।

এরপর দীর্ঘ সময় বিরতি দিয়ে ২০০০ সালে ফের বাংলাদেশে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এরপর থেকে কোনো বছর বাড়ছে আবার কোনো বছর কমছে ডেঙ্গু রোগী। বিগত ১৯ বছরের মধ্যে চলতি বছরই ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে শুরু করে গত বছর পর্যন্ত ১৯ বছরে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন ৫০ হাজার ১৭৬ জন। মারা গেছেন ২৯৬ জন। সব মিলিয়ে ডেঙ্গু শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৬৭ হাজার এবং মারা গেছেন ৩১০ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখান অনুযায়ী, ২০০০ সালে দেশে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছিলেন ৫৫৫১ জন এবং মারা গেছে ৯৩ জন। এরপর ২০০১ সালে আক্রান্ত ২৪৩০ জন এবং মারা গেছে ৪৪ জন। ২০০২ সালে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ২৩২ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। ২০০৩ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৮৬ জন এবং মারা গেছে ১০ জন। ২০০৪ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৪৩৪ জন এবং মারা গেছে ১৩ জন।
২০০৫ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ১০৪৮ জন এবং মারা গেছে ৪ জন।

২০০৬ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ২২০০ জন এবং মারা গেছে ১১ জন। ২০০৭ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৬৬ জন, ২০০৮ সালে ১১৫৩ জন, ২০০৯ সালে ৪৭৮ জন এবং ২০১০ সালে ৪০৯ জন আক্রান্ত হলে কেউ মারা যাননি। এর পর ২০১১ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ১৩৫৯ জন এবং মারা গেছে ৬ জন, ২০১২ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ৬৭১ জন এবং মারা গেছে ১ জন।

২০১৩ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ১৭৪৯ জন এবং মারা গেছে ২ জন। ২০১৪ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৭৪ জন এবং কেউ মারা যাননি। ২০১৫ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ৩১৬২ জন এবং মারা গেছে ৬ জন। ২০১৬ সালে হঠাৎ করে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ৬ হাজার ৬০ জনে বেড়ে যায়। সে বছর ডেঙ্গুতে মারা যায় ১৪ জন।

২০১৭ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ৭৬৯ জন। মারা যায় ৮ জন। ২০১৮ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ১০১৪৮ জন এবং মারা গেছে ২৬ জন। ২০১৯ সালে (৩১ জুলাই পর্যন্ত) আক্রান্ত হয়েছে ১৭ হাজার ১৮৩ জন এবং মারা গেছেন ১৭ জন। চলতি বছর শেষ নাগাদ মৃতের সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

অন্যান্য বছর যেখানে কিছু জেলা এ রোগের আওতামুক্ত থাকতো, এ বছর দেশের ৬৪টি জেলায় তা প্রকোট আকার ধারণ করেছে। ফলে সরকারি ও বেসরকারিভাবে নেয়া সব উদ্যোগ যেন ভেস্তে যাচ্ছে। ফলে, দিন যত যাচ্ছে আক্রান্তের সংখ্যা ততোটাই বাড়ছে।

উৎসঃ একুশে টিভি