৩ জন নটরডেমিয়ানের নটরডেম কলেজে চান্স পাওয়ার গল্প

নটরডেম কলেজ!!!
এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি বা কলেজটি অনেক অনুভূতি,ভালোবাসা ও স্মৃতির জায়গা।সকল নটরডেমিয়ানের জন্য যেনো একটি ব্যাংকস্বরুপ যেখানে ২ বছরের সকল স্মৃতিগুলোকে জমিয়ে রাখে যা ভুলার নয়।

আজ ও শত ব্যাস্ততার ফাঁকে দুজন অপরিচিত নটরডেমিয়ানের ও যদি দেখা হয় শহরেরে বা গ্রামের রাস্তার কোনো এক মোড়ে অথবা শহরের যানজটে কিংবা যেকোনো ভাবে তাদের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করার মতো নয়।

আবার কল্পনায় ফিরে যায় সেই কলেজ জীবনের টুকরা সময়টিতে।চায়ের আড্ডা বলি, টিএসসিতে বসে আড্ডা অথবা মেসেজন্জার রুম, জুম কিংবা গুগল ডু’তে যখন নটরডেমিয়ানদের কথা হয় তারা তখন বর্তমান ছেড়ে সেই টুকরো সময়ে ফিরে যেনো নতুন মনে হয় প্রতিটি গল্প।।

এখনো প্রাক্তন নটরডেমিয়ান বলে শব্দ ব্যবহার করে নি কেনো না –“Once A Notredamian is always a Notredamian”

আজ লিখবো তিনজন নটরডেমিয়ানের নটরডেম কলেজে চান্স পাওয়ার গল্প।নটরডেম ভর্তি পরিক্ষা দিয়ে চান্স অন্য সব কিছু থেকে আলাদা। কেনোনা আপনার গন্তব্য একটিই।আবার জীবনের প্রথম প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরিক্ষা।তবে পরিশ্রম,ভাগ্য দুটোই কাজ করতে হবে এক্ষেত্রে।।

 

গল্প-১

Badhon Amin
Ndc Identity:-11902044

 

প্রথমেই জানাতে চাই, আমি কোনো অসাধারণ মেধাবী ছাত্র নই। বরং খুবই সাধারণ একজন ছাত্র যার পড়াশোনা নিয়ে খুব একটা আগ্রহ ছিল না । বরং আমার আগ্রহ ছিল অন্যকিছুতে।

ব্যক্তিগত ভাবে আমি একজন ভ্রমণ পিপাসু মানুষ । দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘোরা , সেখানকার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানা আমার নেশা ।

এস এস সি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আমি এবং আমার আমার কয়েকজন বন্ধুর একটি ছোট্ট দল পরিকল্পনা করি যে, রেজাল্ট প্রকাশের আগ পর্যন্ত দেশের যতটুকু অঞ্চল ঘোরা সম্ভব , আমরা ঘুরবো । পড়াশোনা কিংবা ভর্তি পরীক্ষা কেন্দ্রিক কোন চিন্তাভাবনা তখনও আমার মধ্যে ছিলো না ।

আমরা পরিকল্পনা মোতাবেক ঘুরতে চলে যাই । প্রায় আড়াই মাস সময় আমরা এই ঘোরাঘুরির পেছনেই ব্যয় করে ফেলি । রংপুর, রাজশাহী , খুলনা বিভাগের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলগুলোয় আমরা ততোদিনে ঘুরে এসেছি । এভাবে এস এস সির ফলাফলের দিনও একসময় চলে আসে ।

সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় ফলাফল আশানুরূপ হয় । রেজাল্টের পর একজন শিক্ষার্থীর প্রথম চিন্তা যেটা আসে তা হল, ” স্কুল তো শেষ। এখন আমার পরবর্তী গন্তব্য কোথায়? ”

আমি ঢাকার একটা সাধারণ স্কুলের ছাত্র । আমার স্কুলের তেমন নামডাক নেই । তাই স্বাভাবিকভাবেই কোন স্বনামধন্য কলেজে পড়ার একটা আগ্রহ সৃষ্টি হয় ।

অনলাইনে দেওয়া লিস্ট অনুযায়ি কিছু কলেজের নাম সাবমিট করি ঠিকই , কিন্তু সেটার ফলাফল দেয় সম্ভবত একমাস কিংবা দেড়মাস পড়ে ।

এতদিন উৎকন্ঠায় কাটানো একটু কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে গিয়েছিলো । হঠাৎ পরিচিত এক আত্মীয়ের মাধ্যমে আমি জানতে পারি নটর ডেম কলেজের ব্যাপারে । নামটি আগেও শুনেছিলাম । বিখ্যাত কলেজ , তবে বিশেষ কিছু জানতাম না কলেজটি সম্পর্কে ।

এবার আমি একটু ঘাটাঘাটি করতে বসি । নটর ডেম কলেজের কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য আমার নজর কাড়ে । বিশ্বজুড়ে নটর ডেমিয়ানদের পদস্পর্শ রয়েছে ।

ঢাকার অন্যতম সেরা কলেজ তো বটেই , কলেজটিতে পড়াশোনার পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস এর প্রতিও যেভাবে জোর দেওয়া হয় তা প্রশংসনীয় । আরও শুনলাম সেখানকার শিক্ষকদের পাঠদানের প্রক্রিয়া নাকি অন্যরকম ।

যা প্রমাণ করে এইচ এস সি পরীক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিপরীক্ষাতে সেখানকার ছাত্রদের সাফল্যগাথা । এটিও আকর্ষণের একটি কারণ ।

কলেজটি অনলাইনে আবেদনের তালিকায় ছিলো না। নটর ডেম কলেজের ছাত্র হওয়ার জন্য আলাদা ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয় । ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম ইতিমধ্যে পাওয়া যাচ্ছিল । তাই ফর্ম পূরণ করে নিজের কিছু বন্ধুবান্ধবদের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করলাম।

আলোচনা করে যা বুঝলাম , এস এস সির পর ৩ মাস চলে গেছে । আমার পড়াশোনার সাথে কোনো সম্পর্কই নেই এবং ভর্তি পরীক্ষা প্রায় চলে এসেছে । অনেক ছাত্রই নাকি এস এস সির পর থেকে এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে । তাদের তুলনায় আমি অনেকখানি পিছিয়ে ছিলাম ।

দেরি না করে হাতে যা সামান্য সময় ছিলো তাই নিয়ে পড়তে বসে পড়লাম । খবরের কাগজে কলেজের ভর্তি বিজ্ঞাপনে কিছু দিকনির্দেশনা আর বোর্ড বই ছিলো আমার একমাত্র অবলম্বন। তবে আমি নতুন কোনো টপিক শিখছিলাম না । আমি জোর দিচ্ছিলাম আমার বিগত ২ বছরের অর্জিত জ্ঞানের উপর ।

কলেজের ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে খুব একটা তথ্য জানতে পারি নি । তাই বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর বাইরেও বাংলা ইংরেজি এসকল পাঠ্যবইও দেখে গিয়েছিলাম ।

সৌভাগ্যক্রমে আমার এই সামান্য প্রস্তুতি আমার জন্য যথেষ্ট হয়ে উঠে । বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বাদেও প্রশ্ন আসে এবং আমি সেগুলোর উত্তর দিতে সক্ষম হই । ক্যালকুলেটর ব্যবহার করার ব্যাপারে কিছু নিষেধাজ্ঞা ছিলো । এ সম্পর্কে খুব একটা না জানায় খানিকটা বিপাকে পড়েছিলাম ।

লিখিত পরীক্ষার পর মৌখিক পরীক্ষা হয় এবং সেটাও ভালোভাবেই শেষ হয়। ভর্তি পরীক্ষার স্মৃতি বাদেও সেদিনের যে স্মৃতি আমার এখনো মনে পড়ে, তা হলো কলেজের ক্যাম্পাসে প্রথমবার প্রবেশ করার স্মৃতি।

ভর্তি পরীক্ষার আগে নটর ডেম কলেজ সম্পর্কে যা ধারণা ছিলো সব ছিলো ইন্টারনেট ভিত্তিক । কিন্তু পরীক্ষার দিন ক্যাম্পাস দেখার পর মনে হয়েছিল ইন্টারনেটে কেবল বিশাল জলরাশির এক বিন্দু জল আমি দেখেছি । কলেজ ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য আসলে লেখনির মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব না ।

সেই মূহুর্তে মনে মনে একটু ভয়ও হয় । হাজার হাজার প্রতিভার মাঝে যদি টিকতে না পারি, তাহলে হয়তো এই ক্যাম্পাসে দ্বিতীয়বার আসার সুযোগ হবে না। পরবর্তী কয়েকটা দিন এই ভয়েই কাটে ।

অতঃপর খবরের কাগজে ফলাফল প্রকাশিত হয় । শংকিত মনে রোল গুলোর মাঝে নিজের রোল খানি খুজতে থাকি । একসময় চোখে পড়েও যায় । আর এর মাধ্যমেই নিশ্চিত হয়ে যায় আমার আগামী দুই বছরের গন্তব্য – নটর ডেম কলেজ ।

 

গল্প-২

 

Kazi Reyaxul Hasan
Ndc Identity:-11902008

 

বেশ সনামধন্য স্কুলের অংশ হিসেবেই জীবনের শুরুটা হয়েছিল। সেন্ট যোসেফ পরিবারের সাথে জীবনের আটটি বছর সুন্দরভাবে কাটিয়েছি বন্ধু বান্ধবদের সাথে।

স্কুল থেকে যখন কলেজে উঠার পালা তখন বেশ স্বাভাবিক কারনেই সেন্ট যোসেফের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন না করে এখানেই পড়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু দেশের সেরা কলেজ এবং সেন্ট যোসেফ ছাত্রদের বিশেষ আকর্ষণ এই নটরডেম কলেজ।

সেখানে পরীক্ষা না দেওয়া মানে বড় একটা অভিজ্ঞতা মিস। তাই খুব একটা ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও নিজেকে অনেকটা প্রমানের উদ্দেশ্যেই নটরডেম ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেই।

এ পরীক্ষার জন্য বিশেষ কোনো প্রস্তুতি ছিল না বটে। কিন্তু এসএসসি এর মোটামুটি ভালো প্রস্তুতি এবং মিশনারি স্কুলের জন্য হোমগ্রাউন্ড সুবিধা থাকার জন্য চান্স পেতে বেগ পেতে হয়নি।

নটরডেম কলেজে পড়াটা আল্লাহ এর ইচ্ছার উপর নির্ধারিত হয়েছে।ভর্তির আগেরদিন ও জানতাম না নটরডেমে পড়া হবে কীনা!

কিন্তু হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ বেশ মনে রাখার মতো দুটি বছর কেটেছে এই কলেজে। আল্লাহ এর কাছে এজন্য চিরকৃতজ্ঞ থাকবো সবসময়। শিক্ষক, ক্যাম্পাস এবং বন্ধুরা সবাই ভালো থাকুক, এই প্রত্যাশা।

গল্প:-৩

Shaswata Roy
Ndc Identity:-11902019

 

নটরডেম কলেজ! এই কলেজে চান্স পাওয়া তো চারটে খানিক কথা নাহ। অনেক মেধাবীরাই এখানে চান্স পাই না। এরকম অনেক কথা আমাকে শুনতে হয়েছিল যখন আমি এসএসসির পর নটরডেমে পড়ার ইচ্ছা পোষণ করতাম মানুষের কাছে।

কথাগুলো আমাকে অনেক ডিমোটিভেট করতো। আমি ভাবতাম সারা বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার জিপিএ-৫ পাওয়া মেধাবী ছাত্ররা যেখানে একে অপরের প্রতিযোগী হবে সেখানে আমার রোলটি সমকাল পত্রিকায় আসবে কিনা সেই চিন্তায় থাকতাম যদিও সেটি ভিত্তিহীন ছিল।

আমি এসএসসি রেজাল্ট দেয়ার আগ পর্যন্ত নটরডেমের জন্য তেমন প্রিপারেশন নেয়নি। যেদিন আমার এসএসসি রেজাল্ট দিল সেদিন কিছুটা আত্নবিশ্বাস পেলাম নিজের মধ্যে। প্রত্যেক বিষয়ের মার্কস গড়ে ৯০% ছিলো যা ছিলো আশাতীত।

এই নম্বরগুলো আমার  নিজের অর্জিত, আমার বন্ধুদের এতে কোন অধিকার নেই। নম্বরগুলো আমারে আরো অনুপ্রাণিত করে নিজের ওপর ভরসা বাড়াল।

আমাকে  অনেক বন্ধু এসএসসির পর ঢাকা যেয়ে নটরডেমের জন্য কোচিং করতে আরম্ভ  করল, তারা মাঝে মাঝে বলত কোচিং না করে চান্স পাওয়া একটু কঠিন।

আমার কথাটা শুনে মন খারাপ হয়ে যেত। কিন্তু আমার ভাই বলেছিল কোচিং লাগবে নাহ, নিজের পড়াটাই মুখ্য। আমি তাকে বিশ্বাস করি সবসময়।

আমার বড় ভাই নিজেও নটরডেমিয়ান। তাই ছোট থেকেই নটরডেমের বিশেষত্বের সাথে আমি পরিচিত ছিলাম, ছোট থেকেই আমার  স্বপ্ন ছিল যে এখানেই পড়ার। তাই এসএসসিরফল প্রকাশের পর আমি  ভাবলাম কিভাবে নিজেকে তৈরি করব?

১৫ জুন পরীক্ষার তারিখ ছিলো। আমার সামনে আর মাত্র ১৭ দিন। প্রথমেই দেখলাম আমি কিছু ভুলে গেছি কি না সময়ের তাড়নায়। বই খুলে দেখলাম সবই মনে আছে। তাই একটু স্বস্তি পেলাম।

আমি জানতাম যে নটরডেম কলেজ সহজ কিন্ত দেখতে জটিল” এমন প্রশ্ন করে। এসব প্রশ্নের উত্তর তখনি করা সম্ভব যখন টপিক গুলো বুঝে  আয়ত্ব করা যায়, মুখস্থ করে নয়। নটরডেম চায় যে ছাত্রটি যেন নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নিজের অর্জিত জ্ঞানের পূর্ণ ব্যবহার করে।

প্রিপারেশনের ক্ষেত্রে আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করছে বোর্ড বই ও টেস্টপেপার। বলা বাুল্য এগুলোই ছিলো আমার একমাত্র অবলম্বন। আমি প্রতিদিন দুইঘন্টা করে অংক প্র্যাকটিস করতে থাকলাম।

তার থেকে ভালোভাবে সুত্রগুলোর প্রয়োগ ব্যবধি বুঝতেচেষ্টা করলাম। পদার্থ বইয়ে দাগানে গুরুত্বপূর্ণ টিকাগুলো দুদিনের মধ্যে পড়ে শেষ করলাম।

রসায়নের জৈব যৌগটা আবার ভালো করে রিভাউ দিলাম। এক্ষেত্রে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই আমার শিক্ষককে যে রসায়নের মত নীরস বিষয়টিকে আমার মনে আনন্দে রসসম্ভারে রূপান্তর করেছে।

যখন মোটামুটিপড়া শেষ তখন দেখলাম আমার হাতে  আরো ৩ দিন আছে। পরীক্ষার আগের দিন বাদে আরো ২ দিন। আমি ঐদুদিন সুত্র গুলো মনে করে অনেকভাবে প্রশ্ন ভাবতে থাকলাম।

আসলে মেডিকেল সাইন্স বলে, পরীক্ষার ২-৩ দুন আগে থেকে সময় থাকলে চোখ দিয়ে না পড়ে মনে মনে ভাবা উচিত। আমি তাই করলাম।

১৫জুন ১১টাই পরীক্ষা দিয়ে বাড়িয়ে ভাবলাম, সবকিছুর উত্তর ঠিকমত দিয়েছি। তাও কেন জানি টেনশন হচ্ছিলো তখন।

একদিন পরে রাতে এক বন্ধু ফোন করে বলল, সমকাল পত্রিকায় আমার রোল ৮০৪৩৪১ আছে।

আমি বেশ খুশি ছিলা্ম কিন্তু আমার থেকেও খুশি ছিল আমার বাবা মা। আমি এটা ভেবে খুশি হলাম যে আমার স্বপ্নের প্রথমধাপে আমিও উত্তীর্ণ।

এভাবে হাজারো নটরডেমিয়ানের কাছে এই সময়টুকু অনেক প্রিয় আসলে  অনেক সাসপেন্সে কাটে সময়গুলো।