ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় কখনো ভাবিনী বিসিএস দিবো

ইঞ্জিনিয়ার,বিসিএস ও জীবনের কিছু না বলা কথা।।

একটা সময় ছিলো যখন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বিসিএস দিবে এটা কেউ ভার্সিটি জীবনে একবারেই জন্যও চিন্তা করেনি।

নিজের কথাই বলি। ভার্সিটি থেকে পাস করার পূর্বে আমার জীবনেই কোন স্টেজেই কল্পনা, স্বপ্ন বা চিন্তা করিনি যে বিসিএস দিবো (প্রবলেম-১)।

বরং ভার্সিটির পড়ার চাপে পিষ্ট হয়ে রুমমেটদের প্রায়ই বলতাম পাশ করার পর নিউজ পেপারও টাচ করবো না।

২০১২ এর জুলাইয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ঢাকায় আসলাম। কি করবো তখনো চিন্তা করিনি,প্রথম মাসটা শুধু ঘুরছি, ব্রেনটাকে বিশ্রাম দিচ্ছিলাম।

একদিন ভার্সিটির এক বড় ভাইয়ের কাছে গেলাম দেখা করতে, ভাই দেশের নাম করা এক ডিজাইন ফার্মের চাকুরী । ভাই পরামর্শ দিলো বিসিএস এর কোচিং করতে।

ভর্তি হলাম বিসিএস কনফিডেন্স, ফার্মগেট শাখা। শুরু হলো এক নতুন যাত্রা। কোচিং এ যাই আসি,রুমে এসে পড়াতো দুরের কথা,বই খাতা ছুয়েই দেখতাম না। কারন বিসিএস এর কোন সার্কুলার দেয়নি তখনো,এক্সাম এর অনেক দেরি এত তাড়াতাড়ি পড়ে কি করবো।

বরং আমি ব্যস্ত ছিলাম ফ্রিলাসিং নিয়ে। এভাবে দুই-তিন মাস চলে গেলো। ততোদিনে বিসিএস এক্সামের সম্পুর্ণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটু ধারণা হলো।

একটা বিসিএস সার্কুলার থেকে শুরু করে জয়েন করা পর্যন্ত প্রায় ২.৫ বছর সময় লাগে। চিন্তা করতেই মাথা হ্যাং। এতদিন অপেক্ষা করবো নাকি একটি চাকরির জন্য(প্রবলেম-২) ?

এটা আমাকে দিয়ে হবে না। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর সকল সার্কুলারে আবেদন করা শুরু করলাম। বিসিএস কোচিং মাঝে মাঝে ইচ্ছা হলে যাই না হলে নাই, এখন আমার প্রধান টার্গেট একটা সরকারি চাকুরী করে পাশাপাশি ফ্রিলাসিং করবো।

২০১৩ সাথে ফেব্রুয়ারিতে প্রথম সরকারি চাকরির পরিক্ষা দিলাম এটোমিক এনার্জি কমিশনে।৩ টা পোস্ট ১৫ জন পরীক্ষার্থী। এক্সামের আগের দিন বাড়ি থেকে আসছি,পড়া হয়নি একটা ওয়ার্ডও।

ফলাফল প্রত্যাশিত(ফেল) ছিল। এরপর বেশ কিছু এক্সাম ঠিক একই ভাবে দিলাম,দিন দিন ফেলের পাল্লা ভারি হতে থাকলো। ২০১৩ এর মাঝামাঝি সময় ৩৪এর প্রিলিমিনারি পরিক্ষা হলো।

কোচিং-এ কিছু মডেল টেস্ট দিছিলাম ঐ টুকুই প্রুস্তুতি। ফলাফল ফেল, পরে সংশোধিত ফলাফলে ৪৬০০০ জনকে পাশ করায় আমাদের ০৭ ফ্লাটের আমি,আমার দুই বন্ধু কপোত(USA) ও তুষার(Associate Director) টিকলাম

কিন্তু আমরা কেউ কোন প্রস্তুতি নিলাম না রিটেনের,এমনকি রিটেনের বইও কিনিনি একটাও। মাঝে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সার্কুলার ও পরিক্ষার তারিখ ঘোষণা হলো আমি ৩৪এর রিটেনে অংশ গ্রহন না করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জন্য পড়া শুরু করলাম (প্রবলেম- ৩)।

এখানে বলা বাহুল্য যে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার রিলেটেড জবের প্রিপারেশন অর্গানাইজেশন টু অর্গানাইজেশন ভ্যারি করে।

যে অর্গানাইজেশনের এক্সাম বুয়েট নেয় তাদের জন্য ম্যাথ ফোকাস করে প্রিপারেশন,যেগুলার পরীক্ষা আইবিএ নেয় সেগুলা এমসিকিউ (খুরমির বই) আর ব্যাংক(ইঞ্জিনিয়ারিং), তিতাস গ্যাস এগুলার জন্য আবার আরেক ধরনের প্রিপারেশন।

২০১৩ এর শেষের দিকে বুয়েটে মাস্টার্সে ভর্তি হলাম(প্রবলেম-৪) এবং নিয়মিত ক্লাস পরিক্ষা অংশ গ্রহন করতে থাকলাম আর মাঝে মাঝে জবের এক্সাম।

এই মাসে ম্যাথ, সামনের মাসে খুরমি, পরের মাসে থিউরি এভাবে একেক এক্সামে একেকটা পরি। এক সময় বুঝলাম যে এভাবে নানান ধরনের প্রিপারেশন নিয়ে আমার মত এভারেজ মেধার মানুষ চাকরী পাবেনা ততোদিনে প্রায় ১.৫ বছর অতিবাহিত।

ফ্রিল্যানসিং তখনো চলছিলো পুরো দমে, বাদ দিয়ে দিলাম সেটাও (২০১৪ সালের শেষের দিকে)। সরকারি নতুন পে স্কেল ঘোষণা হলো, সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহ দিগুন হলো।

২ মাস পর ৩৫তম প্রিলি,পড়া শুরু করলাম।প্রিপারেশন খারাপ ছিলোনা কিন্তু ফেল করলাম প্রিলিতে,হতাশ হলাম।জীবনের সবচেয়ে বেসি হতাশ হলাম ৩৬তম বিসিএস এর রিটেনে টেকনিক্যালে ফেল করে। সত্যি কথা বলতে ঐ দিনের চেয়ে খারাপ দিন আমার জীবনে আসেনি।

সরকারি চাকরির চিন্তা বাদ দিয়ে আমি বই খাতা গুছিয়ে প্রাইভেট জবে ঢুকলাম ( ২০১৬ এর শেষের দিকে) ততোদিনে ১০-১৫ টি ভাইভা দিয়েছি। ২০১৭ সালের শেষের দিকে জীবনের শেষ তিনটা ভাইভার রেজাল্ট দেয় এবং আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি তিনটাতেই টিকে যাই।

জনতা ব্যাংক সিনিয়র অফিসার(ইঞ্জিনিয়ার) ,এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল), এলজিইডি ও ৩৬তম বিসিএস(আনসার) কিন্তু ততোদিনে হারিয়ে ফেলিছিলাম জীবনের মুল্যবান ৫ টি বছর। একটা জিনিস বলতেই হবে, ৩৬ এর রিটেন দিয়ে নীলক্ষেতে একটা কোচিং সেন্টারে গিয়েছিলাম ভাইভা সম্পর্কিত ফ্রি ক্লাস করতে। সেখানে গিয়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিসিএস প্রিপারেশনে ধরন আর ডেডিকেশন দেখে সত্যি অভিভুত হয়েছি।

তারা যে সুন্দর একটা অর্গানাইজড ওয়েতে প্রিপারেশন নেয় সেটা তাদের কাছে না গেলে কল্পনা করা যাবেনা (প্রবলেম-৫)

প্রবলেম-১

ইঞ্জিনিয়ারদের মাঝে একটা ধারনা কমন যে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বিসিএস কেন দিবো। এই ধারনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে( যাদি সরকারি চাকরির ইচ্ছা থাকে),আমার মত প্রায় সবাই বের হয়ে আসে কিন্তু দেরিতে। আর যদি দিতেই হয় ভালো ভাবে দেওয়া উচিত।

প্রবলেম-২

ইঞ্জিনিয়ার দের বিসিএস এর দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে একটা বড় প্রব্লেম। এটা সত্য ২.৫ বছরের আগে একটা বিসিএস এর কার্যক্রম শেষ হবে না। কিন্তু অন্য সরকারি চাকরির কথাও যদি ধরি সার্কুলার, প্রিপারেশন মিলিয়ে ১-১.৫ বছর লেগেই যায়।

প্রবলেম-৩

বিসিএস এর প্রিপারেশন এর মাঝে অন্য কিছু ঢুকানো উচিত না। কেউ যদি বিসিএস দিতে চায় তার শুধু বিসিএস এ দেওয়া উচিত।

এটোমিক এনার্জি কমিশনে আমার প্রথম এক্সামে পরিক্ষার্থী ছিল ১৫ জন, আর সেখানেই ২০১৬ সালে সর্বশেষ যে এক্সামে দিয়েছি পরিক্ষার্থী ছিল ১২০০,পোস্ট ছিল ২ টা। তাই কেউ যদি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রিপারেশন নেয় তার শুধু ঐ দিকেই ফোকাস করা উচিত।

প্রবলেম-৪

পাশ করার পর অনেকেই বুয়েট/কুয়েটে মাস্টার্সে ভর্তি হয়। জব এর জন্য প্রিপারেশন নিলে সত্যিই দরকার নাই কারন থিসিস শেষ করতে হলে সব বাদ দিয়ে মাস্টার্স করতে হবে(সম্মুখ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি)।

প্রবলেম-৫

ইঞ্জিনিয়ার দের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো গাইড লাইনের অভাব। আমি যদি শুধু ঢাকা ইউনিভার্সিটির কথা ধরি ওরা বিসিএস ক্যাডার দেখে দেখে বড় হয়। রেজাল্টের দিন প্রতিটা হলে উৎসব হয় তারমানে যে বড় ভাই বিসিএস এর প্রিপারেশন নিচ্ছিল সে হলে থেকে তার সামনেই প্রিপারেশন নিয়েছে।

ওরা দেখে শিখে, বুঝে শিখে। যে পরিবেশটা ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে অকল্পনীয়। আমার পরামর্শ অভিজ্ঞ মানুষদের পরামর্শ নেওয়া অন্যথায় কোচিং এ ভর্তি হওয়া।

বি.দ্র. বিসিএস একটি জব,একটি অপশন মাত্র। দিতেই হবে বা পাইতেই হবে এমন না। আমার ভার্সিটির সকল বন্ধু আমার দিগুন+ স্যালারি পায়, কারো কারো স্যালারি ৬ ডিজিটে চলে গেছে, উদ্যোক্তাও আছে ২-৩ জন। এই লেখাটি শুধু যারা বিসিএস এ আগ্রহী তাদের জন্য,যদি আমার জীবনের ভুল থেকে একজনও শিক্ষা নেয় বা উপক্রিত হয় তবে আমি ধন্য।

মোঃ রবিউল ইসলাম (KUET,CE 2K7)
৩৬তম বিসিএস (আনসার)
স্কোয়াড কমান্ডার, সিপিসি-৩, মাদারীপুর, র‍্যাব-৮