জন্ম থেকেই ডিএমসি

আমাদের ডিএমসিয়ান হওয়ার শুরু সেই জন্ম থেকেই বোধহয়। দু’বোনেরই জন্ম ডিএমসি তে। দু’বোনই পড়ছি ডিএমসি তে।

আরেক বোন আছে আমাদের। ও এখন ইন্টারমিডিয়েট এ পড়ছে। মজার ব্যাপার হল আমরা তিন বোনই কিন্তু পড়েছি হলিক্রস কলেজে।

প্রচণ্ড ব্যস্ত ডাক্তার বাবা-মা আর আমরা তিন বোন মিলে যে পরিবার, সেখানে আমাদের দু’বোনের বাংলাদেশ এর শ্রেষ্ঠ মেডিকেল বিদ্যাপীঠ এ পড়ার সুযোগ পাওয়ার কথা উঠলে ছোটবেলার কথাও উঠে আসে।

ফাওজানের যখন জন্ম আমার বয়স তিন বছর। বয়সের এই পার্থক্য আমাদের দু’জনের বোঝাপড়ায় কিন্তু দুরত্ব তৈরি করতে পারেনি।

বলা যেতে পারে, একদিকে জাফর ইকবাল স্যারের কিশোর উপন্যাস আর সায়েন্স ফিকশন নিয়ে কাড়াকাড়ি আর অন্যদিকে হ্যারি পটারের বই নিয়ে ঝগড়া আমাদের মধ্যে দূরত্বটা তৈরি হতে দেয় নি।

তবে এখন জাপানি অ্যানিম আর মাঙ্গা ( জাপানি কমিক)নিয়েই আড্ডা আর তর্কটা হয় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু হ্যা,ফাওজানকে একটা দিক থেকে মনে হয় একটু বেশিই কষ্ট করতে হত।

যেমন: স্কুলে থাকতে কেবল ভাল রেসাল্ট করলেই আমার চলত। কিন্তু ফাওজানকে করতে হত দ্বিগুন পরিশ্রম।এক, নিজের ভাল রেসাল্ট করা আর দুই, আমার ছোট বোন এই পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ‘ফাওজান ফারুক’ এই পরিচয় গড়ে তলা।

এডমিশন টেস্ট এ আমার ৬ষ্ঠ হয়ে যাওয়া ওর কাজটাকে যেন একটু কঠিনই করে দিল।তবে আমাদের পরিবার এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে।

কখনই দুই বোনের মাঝে কম্পিটিটিভ মনোভাব দূরের কথা, ফাওজানকে আমার মত ভাল রেসাল্ট করেই মেডিকেলে চান্স পেতে হবে, এমন চাপও দেয়নি।

বরং ফাওজানের নিজের ইচ্ছাতেই ওর মেডিকেল এ আসা সারাদেশের মধ্যে ১৮৬তম হয়ে। ওর চান্স পাওয়ার পর সবচেয়ে বড় লাফটা কিন্তু আমিই দিয়েছিলাম।

আমাদের দু’জনের মাঝে কিন্তু আরেকটা মিল আছে। সেটা হয়তবা কোন আনন্দের বিষয় নয়।

আমাদের দু’জনের বেলাতেই মা ছিলেন হাই রিস্ক প্রেগন্যান্সির পেশেন্ট। তাই দু’জনের বেলাতেই মা প্রেগন্যান্সি পিরিওড কমপ্লিট করতে পারেননি।

ফাওজা প্রচণ্ড জন্ডিস নিয়ে এক্সপেক্টেড ডেট এর প্রায় দেড় মাস আগে জন্ম নেয়। এমন বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশেও মা তার মেয়েদের এবং প্রফেশনাল লাইফকে সমান তালে চালিয়ে নিয়ে গেছেন।

নিজ পরিবারকে উপেক্ষা না করে পাশাপাশি প্রফেশনাল লাইফের সাথে আপস না করা- আমাদের সামনে এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমাদের মা।

আমাদের মধ্যে কোন পাসওয়ার্ড নেই। দু’বোনের মাঝে খুনসুটিটাই যেন একটু বেশি হয়। আমাদের ভালোলাগা-মন্দলাগা গুলোকে দুজনে ভাগ করে নিই গল্প করতে করতে।

এডমিশন টেস্টের আগে ও যখন মাঝেমাঝে অনেক হতাশ হয়ে যেত তখন আমিই ওকে সামলাতাম। তবে মিষ্টি কথায় ওকে ভোলানোর চেয়ে বাস্তববাদী হিসেবে গড়ে তোলার পক্ষপাতি।

ফাওজার যে দিকটি আমার সবচেয়ে ভাল লাগে তা হল ও অসম্ভব পরিশ্রমী। আমার তো মনে হয়,ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পিছনে ওর মেধার ভুমিকা অবশ্যই আছে কিন্তু পরিশ্রম এর ভুমিকাই বেশি।

এই ছোট্ট জীবনে যাই সাফল্য হয়তো স্পর্শ করেছি, চেষ্টা করি যেন দুজনই তা ধরে রাখতে পারি। কোন ধরণের অহংবোধ যেন ভেতরে জন্ম না নেয়। ডাক্তার দুজনই হচ্ছি।

এও জানি, ভাল ডাক্তার হওয়ার পথটি অনেক পরিশ্রমের আর দীর্ঘমেয়াদি। হয়ত আরো ৩০-৪০ বছর পর বলতে পারব ডাক্তার হিসেবে কতটা সফল হয়েছি।

তবু প্রতিজ্ঞা একটা রাখি সবসময়ই, যেন জাতি,ধর্ম,বর্ণ,লিঙ্গ, যৌনতা নির্বিশেষে কোন রোগী আমাদের কাছে এসে সুচিকিৎসা ছাড়া ফেরত না যায়।

ফারাহ্ বিনতে ফারুক
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (কে-৭১)
মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় ৬ষ্ঠ স্থান অধিকারী
সেশনঃ ২০১৩-২০১৪

ফাওজান ফারুক
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (কে-৭৪)
মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় ১৮৬ তম
সেশনঃ ২০১৬-২০১৭