সবচেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয় ভিআইপি পেশেন্ট হ্যান্ডেল করতে গেলে

ডাঃ অায়েশা অাক্তার রিনা

 

আমি এমন এক পরিবার থেকে এসেছি যেখানে মেয়েদের পড়াশুনা ও উচ্চশিক্ষাকে খুব একটা উৎসাহিত করা হতো না।

ধারনাটা ছিল অনেকটা এরকম যে এসএসসি আর এইচএসসি পর্যন্ত পড়ার পর একটা ভালো দেখে বিয়ে দিয়ে দেয়াই যথেষ্ট। আমি যখন সেভেনে পড়ি তখন আমার বাসায় এক স্যার পড়াতেন।

তিনি বলেছিলেন দেখো আর ৫ বছরের মধ্যেই তোমার বিয়ে দিয়ে দেয়া হবে। একটা একটা করে বছর যেত আর আমি গুনতাম। এইচএসসি পাশ করার পর স্যারকে খুঁজে বলতে ইচ্ছা হয়েছিল আপনার কথা তো মিললো না।

কৃতিত্বটা দিতে হয় আমার মাকে, উনি সবসময় চাইতেন ওনার মেয়ে অনেক বড় হোক। উনি পাশে ছিলেন বলেই আমার পরিবারের মেয়েদের মধ্যে একাডেমিক দিক দিয়ে আমি আজ সবচেয়ে দূরে আসতে পেরেছি।

ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার নেশা ছিল প্রচণ্ড। প্রতিদিন স্কুলে যাবার সময় আমাকে ৬ টাকা হাতখরচ দেয়া হত।

তিন টাকা দিয়ে রিং চিপস খেতাম, বাকি টাকা জমাতাম। সপ্তাহ শেষে ১৫ টাকা মত জমত,তাই দিয়ে আড়ং এ জেতাম বই কিনতে। সেখানে ব্র‍্যাক থেকে প্রকাশিত ডিজনির ইলাস্ট্রেটেড বই পাওয়া যেত, আমার কাছে পুরোটা কালেকশন ছিল।

এছাড়া প্রতি বছর বই মেলায় বই কেনার জন্য একটা নির্দিষ্ট টাকা আগে থেকেই আলাদা করা থাকত। আমরা চার ভাই বোনকে বড় থেকে ছোট হিসেবে টাকা দেয়া হতো।

এখনো প্রতি বছর বাবা টাকা দেন বই মেলা থেকে বই কিনতে। মানুষজনের কাছ থেকে ধার করে হোক কি লাইব্রেরি থেকে, বই পড়া কখনো থামাইনি।

হেনরি রাইডার হ্যাগারড থেকে স্টিফেন কিং, কোনান ডয়েল থেকে মারগারেট অ্যাটউড- যখন যা ভালো লেগেছে পড়েছি।

মেডিকেলে আসা মূলত মা বাবার ইচ্ছায়। ছোটবেলায় লক্ষ্য ছিল কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হব। লক্ষ্য পূরণে কিছুদূর এগিয়েছিলামও, চান্স পাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই ডিপার্টমেন্টে।

কিন্তু কয়েক মাস পড়ার পর ছেড়ে দেই। নতুন ঠিকানা হয় ঢাকা মেডিকেল। শুরুতে মানিয়ে নিতে কিছুটা কষ্ট হয়েছিল কিন্তু পরে তা ঠিক হয়ে যায়। এখানেই প্রথম কুইজ করা শুরু।

এ পর্যন্ত ডিএমসি কুইজ টিমের হয়ে অনেকগুলো কুইজে অংশ নিয়েছি, চ্যাম্পিয়ন ও হয়েছি কয়েকটায়। নিজের প্রতিষ্ঠানকে বাইরে রিপ্রেজেন্ট করা এক অন্যরকম অনুভুতি।

ডিএমসি ক্যাম্পাসে পথচলা এখন প্রায় শেষের পথে। ইন্টার্ন ডাক্তার হিসেবে এই কয়েক মাসের অনুভূতি মিশ্র।

হাসপাতালে সবচেয়ে আদরের ডাক্তার ইন্টার্নরা। প্রফেসররা যেমন চেষ্টা করেন একদম হাতে ধরিয়ে শেখাতে, তেমনি সিএ রেজিস্ট্রার আইএমও ভাইয়া আপুরা অনেক বেশী আন্তরিক।

কিন্তু তিক্ত অভিজ্ঞতা হয় ভিআইপি পেশেন্ট হ্যান্ডেল করতে গেলে।

তাদের পেশেন্ট পার্টির হম্বিতম্বিতে স্বাধীনভাবে কাজ করাটা একটু দুষ্কর হয়ে পড়ে। তবে এটা সত্য যে শেখার ইচ্ছা থাকলে ডিএমসিএইচের মতো জায়গা আর একটিও নেই।

আমার এখনো মনে আছে যেই রাতে আমার হাতে প্রথম একজন পেশেন্ট মারা গেলো। নিউরো ওয়ার্ড ছিল তখন, অ্যাকিউট সারভাইকাল মায়ালাইটিসের পেশেন্ট।

লোকটার ডাইলেটেড পিউপিল যখন দেখলাম, মনে হল তার চোখের ভেতর দিয়ে যেন পুরো জগতটা দেখতে পাচ্ছি। লোকটার চেহারা আজও ভুলতে পারিনি।

তবে এটাই একজন ডাক্তারের জীবন, এক হাতে রোগী জীবন পাবে তো আরেক হাতে মৃত্যুবরণ করবে। জীবন থেকে যে শিক্ষা পেয়েছি তা হলো নিজেকে বুঝতে শেখা।

নিজের সামর্থ্য কতটুকু তা বুঝতে হবে, তেমনি সীমাবদ্ধতাগুলোও মেনে নিতে হবে। এবং তখনি কেবল আমরা পারি নিজেদেরকে অতিক্রম করে সামনের দিকে আগাতে।

ডাঃ আয়েশা আক্তার রিনা
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (কে-৬৯)
সেশনঃ ২০১১-২০১২