ধন্যবাদ কুয়েট আমাকে আজকের আমিতে পরিণত করার জন্য

সানজিদা রশীদ বহ্নি

কুয়েটে আমি যেদিন প্রথম ভর্তি হই সেদিন ও জানতাম না how drastically KUET is going to change me, আট দশটা সাধারণ মেয়ের চেয়েও বেশি চঞ্চল, হুট করে অবাধ স্বাধীনতা পাওয়া আমি ধরেই নিসিলাম ভার্সিটি আসলে কোনো পড়াশোনার জায়গা না, ওই যে ওই কথাটার মত, একবার ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে গেলে কিছুই পড়া লাগেনা, আর আশেপাশে সবার মত আমারো ধারণা ছিল ভার্সিটিতে যারা ফার্স্ট সেকেন্ড হয় ওরা বদ্ধ পাগল, আঁতেল অথবা ভীনগ্রহের অতিমানব জাতীয় কোনো পদার্থ।

ফলাফল যা হবার তাই, যারপরনাই পাশ করার মত রেজাল্ট এমনকি কোন এক দুই সাব্জেক্টে ফেলের চেয়ে একটু ভাল অর্থাৎ ডি গ্রেড। এরমাঝে বাসা ছেড়ে বাইরে চলে আসার এস্টেটিক হতাশা, অল্প বয়সে প্রেমে পড়া আর সত্যি বলতে গণরুমের কঠিন জায়গাটার চাপ তো কিছু ছিলই!

যে গল্পটা আমি সারাজীবন ভাবতাম কাউকে বলব না, আজকে সেই গল্পটাই লিখে রাখছি এই জন্য যাতে অনেক বুড়ো হয়ে গেলেও খুব ভালো মতন মনে পড়ে What I am today, most of the credit goes to KUET. What I am not today most of the discredit goest to KUET as well.

ফার্স্ট ইয়ার ওইরকম উচ্ছন্নেই গেল। সেকেন্ড ইয়ার ফার্স্ট সেমিস্টার, ক্লাসে মন বসে না, আমি ক্লাসে বসে লেকচার না তুলে গান লিখি, কখনো ছবি আঁকি, সারারাত ফেসবুকিং করি, গল্প করি, ল্যাব রিপোর্ট লেখি ক্লাসে, কোনো স্যারের ভাষাও বুঝিনা, ক্লাসে কি পড়ায় তাও জানিনা। সেই ২-১ সেমিস্টারেই ক্লাস নিতেন কামরুল স্যার, কোর্স EE2111 সম্ভবত। একদিন ধরা খেলাম ক্লাসে বসে ল্যাব রিপোর্ট লেখায়, স্যার ল্যাব রিপোর্ট ছিড়ে ফেললেন সবার সামনে, এর আগেও নানান স্যারের কাছে বকা খেয়ে আসছি প্রতিদিন, ক্লাসে মোবাইল চালাই, পড়া ধরলে পারিনা বিভিন্ন কারণ, কিন্তু সেদিনের ল্যাব রিপোর্ট ছেড়ার ব্যাপারটা একটু বেশিই অপমানজনক। এরপর আসল ইলেক্ট্রিকাল সিটি, আরো অনেকের মত আমিও ২০ এ ০ পেলাম।

ওহ ভুলে গেছিলাম স্যার ছিল আমার রোলমেট, সংগত কারণে খারাপ ছাত্রী হিসেবেই স্যার আমাকে জানতেন এবং প্রচন্ড রাগ নিয়ে আমাকে বলেছিলেন “তুমি ৫১ রোলটার সম্মান নষ্ট করতেছ, you dont deserve this” এবং এই একটা লাইন ছিল এখন পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে অপমানজনক, সবচেয়ে কষ্টকর গিলে ফেলার মত এবং for my life time I wont forget this ever that there is something else that I dont deserve. এইটা আমার মানতে ইচ্ছা করল না। আমি হলে গিয়ে আস্তে আস্তে পড়া বোঝার চেষ্টা করলাম, প্রথম প্রথম প্রচন্ড অপমানে আমার কান্না আসত, কিছুই মাথায় ঢুকত না, সেই বছর রোজার ছুটিতে ইলেক্ট্রিকাল বইয়ের সব সার্কিট আমি একা সলভ করছিলাম আমার মনে আছে জাস্ট বিকজ I dont believe there is something i dont deserve.
ফলাফল খুব একটা ভাল হওয়ার আগেই কোনো এক সু(!!) বন্ধু ইলেক্ট্রিকাল ক্লাসেই আমার প্রক্সি দিল, ফলাফল যা হবার তাই, স্যার একরকম আমাকে চিহ্নিতকরণ পূর্বক ক্লাস থেকে বের করে দিয়ে একদম ইলেক্ট্রিকাল বিল্ডিং থেকে টেক্সটাইল হেডের রুমে পাঠালেন, একই সাথে একটু একটু করে ভাল করার চেষ্টাটা বিফলে যাওয়ার কষ্ট আর দোষ না করেও শাস্তি পাওয়ার কষ্টে আমি হাউমাউ করে কাঁদলাম এবং ওই শেষবার আমি হেরে যাওয়ার কষ্টে কাদছিলাম।

নিজের উপর প্রচন্ড জেদ হল, ক্লাসে যে মেয়েটা ফার্স্ট হয় সে যদি পারে আমি কেন পারব না, ২-২ সেমিস্টার শুরু করার আগে determined হলাম। সব ক্লাস মন দিয়ে করা, এমন কোনো কিছু নাই যেটা আমি শেখার চেষ্টা করিনাই। ততদিনে কামরুল স্যার ও হায়ার স্টাডিজের জন্য দেশের বাইরে চলে গেছেন।
মানুষের যদি ১০ বার পড়লে মনে থাকত, আমি সেটা ৫০ বার পড়তাম, এখনো মনে আছে ২-২ তে মেকানিক্স এন্ড মেশিন ডিজাইনের কিছু বিশ্রি ম্যাথ ছিল, এমনও ম্যাথ ছিল আমি ৮৯ বার প্রাকটিস করছিলাম। ২-২ পরীক্ষা দিয়ে বাসায় আসলাম ঢাকায়।

বাসায় এসে আব্বা আম্মাকে সামনে রেখে বললাম এই প্রথম আমি জীবনের সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করছি, আমি প্রমাণ চাই, অল্প মেধা থাকলেও পরিশ্রম মানুষকে ভাল ফল দিতে পারে। এই সেমিস্টার এ আমি সবচেয়ে ভাল পরীক্ষা দিয়ে আসছি। আমি ফার্স্ট হব। রুমমেট এবং অনেকেই আমাকে বুঝাইছিল ভার্সিটি লাইফে টিচাররা সবাই নাকি মুখ চিনে মার্ক দেয়,একবার যে ফার্স্ট হয় সেই বারবার ফার্স্ট হয়, নাহলে সেকেন্ড থার্ড এরাই ভাল করে, সিরিয়ালের একেবারে পেছন থেকে এসে কেউ কোনোদিন ফার্স্ট হয়না।

আমি আব্বু আম্মুকে বললাম এইবার আমি ফার্স্ট না হলে আর কোনোদিন পড়াশোনা করব না, বিসিএসের বই খাতা কিনব, ইঞ্জিনিয়ারিং আমাকে দিয়ে হবেনা।

কিন্তু আমাকে দিয়ে হল। আমি ৩.১১ থেকে ৩.৯৪ পেয়ে সেই সেমিস্টারে ফার্স্ট হলাম, সবাই অবাক হল, শুধু অবাক হইনাই আমি, I remember what I get that I deserve. বিশ্বাস হইল চেষ্টা করলে সবই সম্ভব। বিশ্বাস হইল ভার্সিটিতে কেউ মুখ চিনে খাতা দেখে না, ভার্সিটিতে একদম পিছন থেকে এসেও ফার্স্ট হওয়া যায়।

এরপরের সেমিস্টার এ টার্গেট আরো শক্ত। ৪ এ ৪ পেতে হবে। তখনো আমার ব্যাচে কেউ ৪ পায়নাই, আমি চেষ্টা করতে থাকলাম। আমি তিনটা টিউশনি করতাম, নিজের খরচ নিজেই চালানোর চেষ্টা করতাম, প্রেম ও করতাম এরপরে হলে এসে পড়তাম, কুয়েটের প্রচন্ড গরমে আমি খাটের চারপাশে বিছানার চাদর আটকায় পড়তাম যাতে কারো মুখ দেখে ডিস্ট্রাক্ট না হই।
হয়তো ব্যাপার গুলা ততটাও কঠিন না কিন্তু আমার মত স্বল্প মেধাসম্পন্ন মানুষের জন্য ততটাই কঠিন কারণ মানুষের যেটা একবারে হইত আমার সেটা বুঝতে লাগত ১০ বার, ৩-১ এ একাউন্টিং পরীক্ষার দুইদিন আগেও আমি ডিপার্টমেন্ট এর প্রোগ্রামে এংকরিং করছি, কোনোদিন কোনো ট্যুর মিস দেইনাই, কোনোদিন কোনো হ্যাং আউট মিস দেইনাই, সব পেয়ে রুমে এসে আবারো কঠিন পরিশ্রম করছি।
সেমিস্টার পরীক্ষার দীর্ঘ ২৬ দিন সেই বছর আমি ঘুমাইছি দৈনিক এক ঘন্টা। সবাই ৬ সেট বা ৮ সেটের প্রিপারেশন নিল আমি নিলাম পুরা বইয়ের। টার্গেট একটাই, চার।
কোনো একজন ক্লোজ বান্ধবি এই অবস্থা দেখে পরীক্ষার আগের রাতে এসে বলল এবার এত চেষ্টা করলেও তুই ফার্স্ট হবি না, আগেরবার মিশফা ফার্স্ট হয়নাই এবার সে হবেই।

মিশফার প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখেই বলতেছি মিশফা ফার্স্ট হোক বা যা ই হোক, আমার লক্ষ্য ছিল চার। আমি সেইবার চার পেলাম।

সেদিন বাসায় এসে ক্যালকুলেটর এ গুনলাম, ৩-১ থেকে সামনের সব সেমিস্টার এ আমি যদি ৪ পাই আমার সিজিপিএ হবে ৩.৭৩ আর মিশফা তো নিশ্চিত ৩.৯ এর উপরে। তার সাথে আমার কোনোদিন কোনো ককম্পিটিশন ছিল না ঠিক, কিন্তু আমার লক্ষ্য সেদিন থেকে শুরু হল, When I will leave Kuet, I will not leave without having 3.73 in my bag. অর্থাৎ সামনের সবগুলো সেমিস্টারে ৪ পেতে হবে।

সেদিনের পর আর কোনোদিন পেছনে ফিরতে হয়নাই, শেষ চারটা সেমিস্টারেই আমি ৪ পেয়েছিলাম, জোড় সেমিস্টারের প্রচন্ড ঠান্ডার রাতে হলের বারান্দায় বসে পড়ছি আমি, দিনে সবাই জেগে থাকত, পড়া হতোনা তাই কোনো পিএলে আমি দুপুরে ভাত খাইনাই, ওই সময়টায় আমি ঘুমাতাম, খাইতাম সেদ্ধ কাপ নুডলস, আর সারারাত জেগে থাকতাম। দৈনিক ঘুমাতাম ৩ ঘন্টা।

রোদ, বৃষ্টি, ভূমিকম্প কোনোদিন কোনো ক্লাস মিস দিতাম না, কোনো কারণে মিস হলে লেকচার রেকর্ড করতাম, বাসায় এসে নোট করতাম। যত কঠিন যত অসাধ্য আমি তত বেশি আগ্রাসি হয়ে উঠলাম এমনকি মনে আছে ৩-২ এর সময় নির্বাচনের জন্য হল ভ্যাকান্ট করে দিল, বাসায় এসে দেখি পড়াশোনা হয়না, আবার ক্যাম্পাস ফেরত গেলাম।

স্বপ্ন ছিল যে বিশ্ববিদ্যালয় আমার পুরা গল্পটাকে এভাবে পাল্টে দিছে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হব আমি। সবচেয়ে স্বল্প মেধাবী কিন্তু সবচেয়ে পরিশ্রমী একজন মানুষ হিসেবে নিজের গল্পটা আমি আমার স্টুডেন্টদের শোনাব, কিন্তু সেই স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত আর সত্যি হয়নাই।
শেষের দিকে আমি অপেক্ষা করতাম কামরুল স্যার ফেরত আসলে একদিন ধন্যবাদ দিব, হয়তো উনি সেদিন সেইভাবে না বললে নিজেকে আর চেনাই হইত না।

কামরুল স্যার ফেরত আসলেন, ভয়ে কিংবা সংকোচে আর কোনোদিন বলা হয়নাই, ধন্যবাদ ও সেইভাবে দেয়া হয়নাই। পাশ করার আগেই চাকরি পেলাম। এখন আমার আর আমার সেই গল্পের কুয়েটের মাঝে বিস্তর দূরত্ব।

আজকে কুয়েটে শিক্ষক নিয়োগের আবেদন জমার শেষ দিন ছিল। আমি এখন স্ব-কর্মস্থলে ভালো একটি অবস্থানেই আছি। হয়তো যে স্বপ্নটা অনেক পরে আমার মধ্যে কাজ করছিল সেটা আমারো আগে অন্য কেউ প্রাপ্য হয়ে গেছে। যিনি শিক্ষক হবেন তিনি নিশ্চয়ই আমার চেয়ে অনেক বেশি ওই অবস্থানটা পাবার যোগ্য, তবুও এই দিনটায় এসে আমার মনে হয় আমার কুয়েট চ্যাপ্টার এখানেই শেষ।

ধন্যবাদ কুয়েট। আমাকে আজকের আমিতে পরিণত করার জন্য, ধন্যবাদ কুয়েট, এই অসম্ভব “জেদি কনফিডেন্ট” আমাকে চেনার জগৎটা দেখানোর জন্য।
একটা না পাওয়া অসম্ভব মরিচীকার পিছে ছুটতে ছুটতে আমি বিশ্বাস করতে শিখেছি there is nothing in this world that you dont deserve, there is nothing in this world that is impossible. All good wills will make a very different way. Today or Tomorrow 🙂

লেখক: সানজিদা রশীদ বহ্নি
টেক্সটাইল’১৫