‘আমার ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার হতে কুয়েটে পাঠিয়েছিলাম, সে মাদক পেলো কিভাবে?’

এ.কে.এম আহসান উল্লাহ ভূইয়া

কুয়েটে আমাদের শিক্ষক হত্যার বিচার চাইছেন অনেকে। সেলিম স্যারকে ছাত্রলীগের হায়েনারা মেন্টাল টর্চার করে মেরেছে। পরিচিত চেহারার অনেক স্যারকেই মানব বন্ধনে দেখলাম।

কুয়েটে ঢুকার আগে শুনেছিলাম সেখানে রাজনীতি নেই। আমার কুয়েট লাইফের টাইমটাতে দুটি ওয়েভ দেখেছি। প্রায় ১ বছর রাজনৈতিক আগ্রাসন মুক্ত ক্যাম্পাস।

এরপর শুরু হল ছাত্রলীগের রাজনৈতিক সময়। নিকৃষ্ট একটি সময়। যা এখনো চলছে।

ছাত্রলীগের রাজনীতি যদি ছাত্ররাজনীতি হয় তাহলে সকলের জেনে রাখা ভালো যে এর জন্য ক্যাম্পাসের আবহাওয়া বিষাক্ত হয়ে উঠছে । একসময় বুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, রুয়েট এ বিষ থেকে মুক্ত থাকলেও এখন সব ক্যাম্পাস এই বিষে বিষাক্ত।

এখানে হাতেগোনা কিছু ছেলেপেলে ক্যাম্পাসের কয়েকটি বছর দাপটের সাথে চলার জন্য ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়, এরপর হয় হায়েনা। মাদকের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক। কিন্তু নষ্ট করে দেয় পুরা ক্যাম্পাসের পরিবেশ।

যারা কুয়েটে গিয়েছেন তারা নিশ্চয় খান জাহান আলী হলের সামনে একটি মুরাল দেখেছেন। ০৫ ব্যাচের মেহেদি ভাই এর মুরাল। এবার কুয়েটে গিয়েও ক্যান্টিনের কর্ণারে দেখলাম ‘মেহেদিস কর্ণার’ নামে একটি টেবিল। কুয়েট ছাত্রলীগের ছেলেপেলে তাকে কুয়েট ছাত্রলীগের মডেল মনে করে।

তিনিই প্রথম কুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগকে সুবিন্যস্ত করেছেন। তাই তৎকালীন রাজনৈতিক ভিসি স্যার ক্যাম্পাসের প্রায় সকল স্যারের বিরুদ্ধে গিয়ে এই মুরাল করেছে। অর্থাৎ ব্রান্ডিং করার প্রয়াস, আরকি। কিন্তু তার মৃত্যুটা ছিল আতকে উঠার মতো ঘটনা। যেকোন বাবা-মায়েরা শুনলে কুয়েটের মতো বিদ্যাপিঠেও নিজ সন্তানকে পাঠাতে ভয় পাবেন।

আট দশটা সাধারণ ছেলে পেলের মতো তিনিও ছিলেন সাধারণ একজন ছাত্র। এরপর ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে পরিচয়। প্যাকেজ হিসেবে সিগারেট, গাজা এবং শেষে মদের সাথে অভ্যস্ত ।

একরাতে অতিরিক্ত বাংলা মদপানের কারনে তিনি সহ তার সাথের আরেকজন ছাত্রলীগ কর্মীর মৃত্যু হয়। আমরা তখন ফাস্ট ইয়ারে। তার লাশকে যখন তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় তখন লাশের গাড়ির সাথে গিয়েছিলেন কয়েকজন স্যার।

তাদেরকে তার মা জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘স্যার, আমিতো আমার ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার হতে কুয়েটে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে কেন এমন পরিবেশ আছে যার কারণে আমার ছেলেকে মাদক পেয়ে বসলো এবং মরতে হল?’

স্যার ক্লাসে এই ঘটনা শুনাচ্ছিলেন আর নিজে নিজেই আফসোস করছিলেন। কারণ মেহেদি ভাই এর মায়ের প্রশ্নের উত্তর স্যারের কাছে নেই।

আমি তখন সেকেন্ড ইয়ারে। প্রতি বছরেই শেষের দিকে টানা ২ দিন হলে খুব উন্নত মানের খাবার দেওয়া হত যাকে আমরা ফিস্ট বলতাম। অমর একুশে হলের বাৎসরিক ফিস্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল হল ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের। পরবর্তিতে এই ফিস্ট ভার্সিটির জন্য একটা ইতিহাস হয়ে যায়।

ছাত্রলীগতো ছাত্রলীগই। তারা সাধারণ ছেলেপেলের ফিস্টের টাকার বিরাট একটা অংশ নিজেদের পকেটে পুরে নেয় এবং খুব নিম্নমানের খাবারের ব্যবস্থা করে। সাধারণ ছাত্ররা এতে প্রচণ্ড খেপে যায় এক পর্যায়ে স্যারদের কাছে জানানো হয়।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বলা হয় এর বিহিত না করলে কোন খাওয়া দাওয়া হবে না। কিন্তু ছাত্রলীগের ছেলেপেলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এ জন্য টিজ করতে থাকে।

ফলশ্রুতিতে সকলে ক্ষেপে উঠে ছাত্রলীগের ছেলেপেলেকে ধাওয়া দেয়। তারা হল ডাইনিং এর পিছনের দরজা দিয়ে দৌড়ে পালায়। ঐ রাতে আর তারা হলে ঢুকতে পারে নি।

কিন্তু তার পরের দিন দুপুরের দিকে বাহির থেকে কিছু ভাড়াটে গুণ্ডা নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে ছাত্রলীগের ছেলেপেলে। এক এক করে মারতে থাকে লিস্টেড বড় ভাইদের। অল্প সময়ের মধ্যে কেয়ামত বয়ে যায় হলের উপর দিয়ে।

স্যারদের মধ্যে কেউ কেউ খবর পেয়ে দৌড়ে আসে হলে। কিন্তু বাইরের গুণ্ডাগুলো স্যারদেরও মারা শুরু করে। এরপর যা হওয়ার তাই হল। সারা ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ বিরোধী স্লোগান শুরু হল।

ছাত্রলীগের ছেলেপেলে ক্যাম্পাস থেকে বাইরে পলালো। সাধারণ ছেলেপেলে তৎকালীন পলিটিক্যাল ভিসি সারের বাসায় ভাংচুর করলো (যা সম্পুর্ণ অন্যায় কাজ ছিল)। বিকেলের মধ্যে সম্পূর্ণ ক্যাম্পাস পুলিশে ভরে গেল। সন্ধ্যার দিকে অল্প সময়ের নোটিশ দিয়ে হলগুলো সিলগালা করা হল এবং ক্যাম্পাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হল।

বুয়েটের আবরার ফাহাদ বা কুয়েটের সেলিম স্যারের মৃত্যুর পর কিছু ছাত্রলীগপ্রেমী হয়তো বলবে এরা ছাত্রলীগ না, এরা ছাত্রলীগের মধ্যে বহিরাগত। এদের থেকে ছাত্রলীগকে মুক্ত করতে হবে।

কিন্তু এদের কে বুঝাবে যে, এরা ছাড়া ঐ হলগুলোতে ছাত্রলীগের আর কেউ বাকি থাকে না। এরা এতোটা খারাপ আগে ছিল না কিন্তু এই বিষাক্ত ছাত্ররাজনীতি এদের হায়েনা বানিয়েছে। তাই ছাত্ররাজনীতির এই সিস্টেমটাকেই বাদ দেওয়া উচিৎ।”

(পোস্টটি লিখেছেন জিরো নাইন ব্যাচের আহনাফ ভাই। ছবিতে কুয়েটে ছাত্রলীগের পুনর্জাগরণের পথিকৃৎ, অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে মারা যাওয়া ছাত্রলীগ নেতা এ.কে.এম আহসান উল্লাহ ভূইয়া (মেহেদী)— এর ম্যুরাল দেখা যাচ্ছে।)