দেশের গবেষণা খাতকে সম্মৃদ্ধ করতে চুয়েট শিক্ষকের অনন্য উদ্যোগ

মোঃ ছাবির হোসাইন

গবেষণা, এই শব্দটা শুনলে যতটা আভিজাত্যপূর্ণ ও কঠিন মনে হয়,বাস্তবপক্ষে সেটা আসলে ততটাই নমনীয়। সত্যি!

হ্যাঁ, এটা আমার কথা না। যুগ যুগ ধরে যারা বিশ্বকে পরিবর্তন করে সম্মৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন, তারাই বলেন এসব কথা।

মুল কথা হলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, আমরা শুরু থেকেই গবেষণার সাথে পরিচিত না থাকায় আমাদের কাছে হয়তো এই ব্যাপারটাকে অন্যরকম মনে হয়।

তবে এর উল্টো পিঠও রয়েছে। দেশে বসেই নানা চমকপ্রদ গবেষণার বিস্তার ঘটিয়ে বিশ্বকে তাক লাগানোর মত অসাধ্য সাধন করেছিলেন আমাদেরই দেশীয় রিসার্চচাররা।

এরই ধারাবাহিকতায় তাঁরা চিকিৎস্যা বিজ্ঞান,প্রযুক্তি বিজ্ঞান, শাস্ত্র বিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান ইত্যাদি নানা বিষয়ে গবেষণা করেছেন।

কিন্তু বাস্তবতা এই যে, দেশের জনসংখ্যা বেড়ে ব্যাপক আকার ধারণ করলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়ন থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ কিছু শাখায় আমরা অন্যান্যদেশের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে।

যেখানে স্নাতক পর্যায়ে গবেষণায় বিশ্বখ্যাত বিদ্যাপীঠগুলো এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত কি হয় সেটা আমাদের অজানা নয়।

তবে,দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় চার বছরের স্নাতকের চূড়ান্ত বছরে আন্ডারগ্র্যাডুয়েট থিসিস এর ব্যবস্থা থাকলেও শিক্ষার্থীদের পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাব ও সময় সল্পতার কারণে অনেক সময়ই কাঙ্খিত মানের সাফল্য অর্জন সম্ভব হয় না।

আবার,গবেষণা যদি ভালো মানের হয় তবে সেটা বিশ্ব দরবারে পোঁছাতে হলে অবশ্যই আনুষঙ্গিক ব্যয় রয়েছে।

আমাদের দেশের গবেষণা খাতের বাজেটের পরিমাণ যে কত কম বা অপর্যাপ্ত, সেটা যারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়নরত তারাই বুঝতে পারে।

কিন্তু কেউ তো আর সিস্টেমের দোহাই দিয়ে পার পেয়ে যাবে না,যেখানে এই পরিস্থিতিতেও আমাদের শিক্ষার্থীরা গবেষণায় মননিবেশ করছেন!

তাদের গাইডলাইনের জন্য এগিয়ে এসেছেন দেশের অনেক শিক্ষক ও গবেষকেরা যা সত্যি আশা জাগানিয়া।

যে যার মত পারছেন সাহায্য করছেন যাতে দেশের শিক্ষার্থীরা সহজেই আন্তর্জাতিক মানের গবেষণায় অগ্রসর হতে পারেন।

কিন্তু আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গবেষণা! তাও আবার দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের, এর নজির কিন্তু হাতে গোনা।

মোঃ ছাবির হোসাইন
মোঃ ছাবির হোসাইন

সেই অসামান্য কাজে যিনি নিজেকে ব্যাস্ত রাখেন তিনি হলেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় – চুয়েটের কম্পিউটার কৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব মোঃ ছাবির হোসাইন

গবেষণার ময়দানে এই দৈন্যদশায় আশার আলো ছড়াচ্ছেন তিনি।

নানামুখী কর্মকাণ্ডে তাঁর প্রতিষ্ঠান ছাড়াও কাজ করছেন দেশী-বিদেশী নামকরা গবেষকদের সাথে। উদ্দেশ্য একটাই,দেশ যাতে এগিয়ে যায়, শিক্ষার্থীরা যাতে বিশ্বমানের সুবিধা পায়, বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে নতুন করে চিনিয়ে দেয় যে আমরাও কোনও অংশে কম নয়।

শুরুর গল্পটা অনেকটা এরকম। চুয়েটের এক অনুষ্ঠানে যন্ত্রকৌশল বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. আব্দুল ওয়াজেদ বলেছিলেন,

বিশ্ববিদ্যালয় নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণের স্থান।

 

সেই কথা দ্বারা প্রচন্ড অনুপ্রাণিত হয়েই শুরু। ২০১৮ সালের ৩০ মার্চে Airline Scheduling with Max Flow Algorithm নামক তার প্রথম পেপারটি প্রকাশিত হয়।

পরবর্তী সময়ে ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন, প্রকাশ করেছেন হয়েছে আরও ২৩ টি গবেষণা প্রবন্ধ।

উনার কাজগুলো দেখতে পারেন গবেষকদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রিসার্চগেট এ (click here)

আন্ডারগ্রাজুয়েট ছাত্র থাকাকালীন শুরু করেন গবেষণার কাজ।

লেগে আছেন এখন পর্যন্ত, তবে কেবল নিজের গবেষণাতেই সীমাবদ্ধ থেকে নয়, চুয়েটের শিক্ষার্থী, শিক্ষক সহ দেশ-বিদেশের গবেষকদের সাথে সমন্বয় করে গবেষণার কাজকে তরান্বিত করছেন।

যেহেতু তিনি একজন শিক্ষকও,তাই গত তিন বছর ধরে চুয়েটের কম্পিউটার কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের অ্যালগরিদম ডিজাইন অ্যান্ড এনালাইসিস কোর্সটি পরিচালনা করে আসছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা পরিস্থিতি উন্নয়নে চিন্তা করলেন কোর্সটির মৌলিক বিষয় পড়ানোর পাশাপাশি কোর্সওয়ার্ক হিসেবে শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও প্রোজেক্ট করতে উৎসাহিত করার কথা।

যেই কথা সেই কাজ,শুরু করেন গবেষণা, তাও আবার স্নাতক ২য় বর্ষের শিক্ষার্থীদের নিয়ে।

কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়েই স্নাতক ২য় বর্ষের শিক্ষার্থীদের স্বীকৃত জার্নালে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশ বিরল ঘটনা।

আর তা যদি হয় কম্পিউটার কৌশলের অ্যালগরিদমের মত জটিল বিষয়ে, তবে সেটা উৎসাহে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করে।

নিজের কক্ষে কাজ করছেন শিক্ষক ও তরুণ গবেষক মোঃ ছাবির হোসাইন

পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতা ও তার  নিরলস প্রচেষ্টার কারণে প্রায় দশেরও অধিক প্রকাশনা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে।

আরো কিছু গবেষণা প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। এই কাজগুলো আই ট্রিপলই (IEEE) স্পনসরড কনফারেন্স, থমসন রয়টার্স ইন্ডেক্সড জার্নাল, স্কোপাস (SCOPUS) ইন্ডেক্সড স্প্রিঞ্জার (Springer) বুক সিরিজসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনফারেন্স ও জার্নালে প্রকাশ হয়েছে।

তাঁর গবেষণার বিষয়ে তিনি বললেন,

“আমি মূলত অ্যালগরিদম কোর্সের সাথে প্রাসঙ্গিক বিদ্যমান বিষয়গুলোকে নতুনভাবে সমাধানের অথবা বিদ্যমান সমাধানসমূহকে আরো উন্নত করার চেষ্টা করি।

কিভাবে অ্যালগরিদমের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা যায় সেই চেষ্টাও করি।

যেমন ধরুন

  • এয়ারলাইন শিডিউলিং এমনভাবে করা যাতে এরোপ্লেন গুলো অধিকাংশ সময় ফ্লাইট মুডে থাকে এবং  প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ লাভ হয়;
  • অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ ব্যবহার করে সহজে নির্দিষ্ট এলাকায় রক্তদাতা কে খুঁজে বের করা;
  • ভ্রমণপিপাসুদের শারীরিক কষ্ট কমাতে সহজে টুরিস্ট স্পটগুলোকে খুঁজে বের করা;
  • কম মূল্যের এবং কাছাকাছি ওষুধের দোকান খুঁজে বের করা;
  • কাছাকাছি কম খরচের সিট খালি আছে এমন হাসপাতাল খুঁজে বের করা; ভাড়া বাসা খুঁজতে সহযোগিতা করা;
  • র‍্যাগিং ঠেকানোর জন্য প্রথম বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ তৈরি করা;
  • ফ্রিল্যান্সারদের লাভজনক কাজ বেছে নেওয়ার জন্য সহযোগিতা করা;
  • কার্যকর গ্রাফ সার্চ পদ্ধতি দেয়া;
  • জেনেটিক অ্যালগরিদম ব্যবহার করে দ্বিঘাত সমীকরণ সমাধানের নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন;
  • ট্রাভেলিং সেলসম্যান সমস্যার কার্যকর সমাধান করা;  ইত্যাদি।

তাঁর রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সাথেও যুক্ত হয়ে গবেষণা অভিজ্ঞতা যা তিনি করে যাচ্ছেন এখনও।

এর মধ্যে রয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার চার্লস স্টুয়ার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. আসাদ কবির, কানাডার ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ড. এনামুল হক প্রিন্স, আমেরিকার হিউস্টোন বিশ্ববিদ্যালয়ের মোঃ মাইনুল ইসলাম, ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া পাহাং এর ড. মুহাম্মাদ নোমানী কবির প্রমুখ।

আরও জানালেন মূলত মেশিন লার্নিং রেকমেন্ডার সিস্টেম ডিজাইন, অ্যালগরিদমের কম্পেক্সিসিটি এনালাইসিস, অগমেন্টেড রিয়্যালিটি, কম্পিউটার ভিশন, তথ্য পুনরুদ্ধার ও প্রদর্শন ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা করেন।

স্নাতক দ্বিতীয়-তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের গবেষণার করার সুযোগ আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেনঃ

সব কোর্সে না গেলেও কিছু কোর্সে গবেষণা ও প্রজেক্ট করার সুযোগ তো অবশ্যই আছে। আর আমি সেটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

তবে পরিশ্রমের বিকল্প নেই। আমি চাই সবার মধ্য থেকে এই ভয়টা দূর হোক। সবাই গবেষণায় মনযোগী হোক।

বেশ কিছুদিন থেকেই তিনি সামাজিক মাধ্যমগুলোতে গবেষণা বিষয়ে প্রচার-প্রচারনা চালাচ্ছেন।

সফলতাও পাছেন বলে জানালেন। মূলত দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে এগিয়ে চলছেন তিনি।

তৈরি করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনলাইন গবেষণায় হাতেখড়ির প্লাটফর্মঃ গবেষক হতে চাই নামক ফেসবুক গ্রুপ।

যেখানে তিনি বিভিন্ন্ ধাপে দেশের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে গবেষণায় হাতেখড়ি দিয়ে থাকেন।

গ্রুপে আরও কাজ করছেন অতিশ দীপংকর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মোঃ নুরুল আমিন ও চাইনিজ একাডেমি অফ সাইন্সের পিএইচডি গবেষক মোঃ রাশিদুল ইসলাম

এছাড়াও গ্রুপে দেশ-বিদেশের অনেক শিক্ষক ও তরুন গবেষক কাজ করার ইচ্ছা পোষন করেছেন।

গবেষণায় আগ্রহী নতুন যে কেউ যাতে গবেষণার হাতেখড়ি পেয়ে যায় এইজন্য তার চ্যানেলে (click here) নিয়মিত লেকচার সিরিজ আপলোড করে যাচ্ছেন।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের বাংলা ভাষা-ভাষী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যপক সাড়া ফেলেছে। ভবিষ্যতে ইংরেজিতেও গবেষণার উপর লেকচার সিরিজ দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন।

স্যারের সাথে কোলাবোরেটিভ রিসার্চ অথবা গবেষণা বিষয়ক সহায়তার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন এই ফর্মের (ফর্ম লিংকঃ click here) মাধ্যমে।

Teaching and Learning method এ বিশ্বাসী এই উদ্যমী শিক্ষক এগিয়ে যাবেন দেশকে নিয়ে।

দেশের গবেষণা খাতে অন্যতম অবদান রাখবেন এই কামনা রইলো।

Engineers’ DiaryCampus Connect পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি রইল আন্তরিক শুভেচ্ছা ও  অভিনন্দন।