আলোর উদ্দীপন ইবাদ জহির স্যার

প্রত্যেকের জীবনে এমন কোনো শিক্ষক থাকেন যিনি তার সবটুকু ঢেলে দেন তার শিক্ষার্থীদের পরম আকাঙ্খ্য স্বপ্নের স্বাদটুকু দিতে, নিজে রয়ে যান আড়ালে।

আমারও জীবনে এমন একজন শিক্ষক রয়েছেন। সম্প্রতি জানতে পেরেছি তিনি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আমার ভার্সিটি ছাড়ছেন ও দেশের বাইরে যাচ্ছেন এবং আমিও আর এক মাস অল্পকয়দিনের মাঝে ইনশা’আল্লাহ্‌ বৃত্তি নিয়ে আমার বহুল আকাঙ্খিত বিষয় “Photonics” (আলোকবিদ্যা) বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভের উদ্দেশ্যে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছি। এ লেখাটি আমার জীবনের সে হিতাকাঙ্ক্ষী শিক্ষক’কে উৎসর্গ করে লিখা।

আমি তখন সবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম বর্ষের ছাত্র।

স্কুল জীবনে স্বপ্ন দেখেছিলাম প্রচুর, কিন্তু কালের মহিমায় ও নিজের কিছু গাফিলতির কারণে ঐ পর্যায়ে এসে মনে হয়েছিল স্বপ্নগুলো হয়ত বেঁচে থাকবেনা বেশিদিন।

খুব কষ্ট হচ্ছিল যানজট-দূষণে ভরা নতুন শহর ঢাকায় টিকে থাকতে, তার উপর তড়িৎ প্রকৌশলীর মত কঠিন বিষয়ের চাপ। প্রতিদিন কোন ঝামেলা ছাড়া পার করাই যেন ছিল সেদিনকার জীবনের মূল লক্ষ্য।

তার উপর কিছু উচ্চমর্গীয় মানুষের একবার সমালোচনা শুনেছিলাম, যা ছিল বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মান নিয়ে কিছু মানহীন কটু কথা।

এরপর থেকে নিজের মাঝে এক হিংস্র তাগিদ অনুভব করি, সংকল্পবদ্ধ হয় এমন কিছু করে ভার্সিটি থেকে বের হতে হবে যাতে লোকেরা আমার যোগ্যতা নিয়ে কটু কথা বলার আগে বাধ্য হয় অনেকবার চিন্তাভাবনা করতে।

ইবাদ জহির স্যারের নাম শুনেছিলাম, অল্প ক’দিন যেতেই। ইন্টেলে চাকরি করা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা ইন্সটিউট অফ টেকনোলজিতে পূর্ণ বৃত্তিতে স্নাতক, স্নাতকোত্তর করা, পরিবারের টানে পি, এইচ, ডি মাঝ পথে ছেড়ে দিয়ে আসা এমন স্যারের নাম না শোনাটাই ছিল যেন অস্বাভাবিক ব্যাপার।

তবে স্যার বিখ্যাত ছিলেন আরও বিভিন্ন কারণে, তিনি ছিলেন চরম পেশাদারিত্ব ও নৈতিকতার এক বিরল দৃষ্টান্ত। কখনো ক্লাসে অপ্রয়োজনীয় কথা বলতেন না, অনৈতিক কিছু প্রশ্রয় দিতেন না এবং সেই সাথে ছিলেন অসম্ভব নিয়মানুবর্তী।

তার নিয়মানুবর্তীতার হালকা উদাহরণ দেই, তিনি ছিলেন ই-মেইলে খুবই সক্রিয়। তার কাছে মেইল করে রিপ্লায় না পাওয়া এমন শিক্ষার্থীর উদাহরণ পাওয়া ভার।

তিনি একবার বলেছিলেন, যদি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমার মেইলের কোন রিপ্লায় না পাও, ধরে নিবা আমি জ্ঞানহীন অথবা মৃত। সর্বদা শিক্ষার্থীদের সাথে শুদ্ধ ইংরেজীতে কথা বলতেন, এমনকি কেউ বাংলায় প্রশ্ন করলেও ইংরেজীতে উত্তর দিতেন।

একজন ছাত্র জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন তিনি বাংলা বলেন না, তিনি উত্তর দিলেন, ভার্সিটি থেকে তাকে বলা হয়েছে, ভার্সিটির মাধ্যম ইংরেজি এবং তাই তিনি অন্য ভাষায় কথা বলতে অনুমতিপ্রাপ্ত না।

তো সাধারণ ছাত্র আমি উনার ব্যাপারে জেনে আগ্রহ হলো, উনার শিক্ষার্থী হওয়ার।

তবে সবচেয়ে সুবর্ণ সুযোগটি হয় ২০১৫ তে, ২য় বর্ষে যখন Mahfuzur ভাইয়ের নেতৃত্বে AIUB Robotic Crew’র যাত্রা শুরু হয় এবং সেখানে আমার কাজ করার সুযোগ হয়।

ARC’র এডভাইজর ছিলেন ইবাদ স্যার। এরপর ARC’র সাফল্যের কাহিনী তো সবারই জানা। প্রায় দেড় বছর হাড়ভাঙা খাটুনির পর আমাদের ১৭ জনের দল কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা বা ব্যর্থতা ছাড়ায় ১ম সুযোগেই University Rover Challenge ২০১৬ তে কোয়ালিফাই করে এবং আমরাই ছিলাম ১ম বাংলাদেশী প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যারা এ ডেডলকটি ভাঙ্গে।

এছাড়াও আমরা চূড়ান্ত পর্বে ফোবোস রাউন্ডে অষ্টম হয় এবং পরাজিত করি বিখ্যাত Mcgill, California State Uni. etc প্রমুখকে।

মুহূর্তে আমাদের জীবন অন্যরকম হয়ে যায়, একের পর এক সংবাদপত্র (প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, সমকাল, কালের কন্ঠ প্রমুখ) আমাদের খবর ছাপা শুরু করে, টিভি চ্যানেলগুলো আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

আমাদের নাম দিক বেদিক ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

ইবাদ স্যারের দিকনির্দেশনা ছাড়া এ স্বপ্ন ছিল সম্পূর্ণ অকল্পনীয়। প্রতিটা কাজের সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা এবং নিখুঁত ফলাফল অর্জন নিশ্চিত করা ছিল তার প্রধান এবং একমাত্র লক্ষ।

যদি তা না হত, তবে সে কাজকে তিনি কাজ বলে গণ্যই করতেন না। তাকে খুশি করা ছিল যেন আমাদের সকলের বিশাল কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

কিন্তু, এভাবে কাজ করতে করতে আবিষ্কার করলাম, নিজের দক্ষতা এমন একটা পর্যায় অতিক্রম করে অনেক দূর চলে গিয়েছে, যার কাছে যাওয়াটাই কখনো সম্ভব মনে করতাম না।

প্রায় অনেকমাস কাজ করার পর স্যার আমাকে একবার বলেছিলেন, “Good Job”। সে সময় আমার মনে হলো, হৃদয়ের উপর দিয়ে এক সুশীতল বাতাশ বয়ে গেলো।

মনে হলো ঐ দুই শব্দের চেয়ে মধুর যেন অন্য কোন শব্দ পৃথিবীতে আর হতে পারে না। আমি আরো মনোযোগী হলাম। এভাবেই স্যারের প্রবল উচ্চাকাঙ্খা ও নিখুঁত বিচার-বিশ্লেষণ আমার নিজের দক্ষতাকে ক্রমাগত করতে থাকে আরও শানিত।

কিন্তু ঐ ১৭ জন ARC সদস্য আর আমার মাঝে পার্থক্য হলো, ARC এর সদস্য হয়ে URC, NASA’র ২ টা মার্স রোভার প্রজেক্টর কাজে স্যার আমার এডভাইজর তো ছিলেন-ই, সেই সাথে তিনি ছিলেন আমার থিসিস এক্সটারনাল ও আমার প্রধান নির্বাচিত বিষয়ের (Elective Course) “OptoElectronic Device (আলোকতড়িৎ সংক্রান্ত যন্ত্রাংশ)” এর একমাত্র শিক্ষক। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন AIUB তে দেখা আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষক।

এত জ্ঞানের গভীরতা, এত চমৎকার পড়ানোর ভঙ্গি, বারবার প্রশ্ন করলে বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হওয়া- এমন সুদক্ষ শিক্ষক আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি। অনেকের কাছে মনে হত, তিনি অতি কঠোর একজন শিক্ষক, আমার কাছে মনে হত তিনিই সেরাদের একজন।

আমার প্রথম পাবলিকেশন টি আসে তারই হাত ধরে, তাও সেটা ছিল অত্যন্ত স্বনামধন্য কনফারেন্সে, যা হয়েছিল জাপানের “Hokkaido University” তে এবং যার আয়োজক ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় Technical Soceitey, IEEE. (Conference paper link: https://ieeexplore.ieee.org/document/7844117/)

 

পূর্ব পরিচয় ও ঘনিষ্ট সম্পর্ক তার পেশাদারিত্বের কাছে কিছুই ছিল না। আমাদের থিসিসে হালকা যান্ত্রিক ত্রুটি থাকার কারণে প্রি-ডিফেন্সে তাকে আশানুরুপ ফলাফল দেখাতে পারিনি।

তিনি আমাদের এমন ভাবে ধুইয়ে দিলেন, যে আমরা লজ্জায় ৩০ মিনিট পর্যন্ত একে অপরের মুখ দেখতে পারছিলাম না। আমরা জানতাম, যদি আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন থিসিস করতে না পারি, তবে ফেইল আমাদের নিশ্চিত।

আমরা উঠে পড়ে লাগলাম। সে ক্ষেত্রে আমাদের শ্রদ্ধেয় সুপারভাইসর ডঃ নাসির স্যারের কথাও বলতে হয়, তিনি আমাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা ও সুকার্যকরী দিকনির্দেশনা দেন।

নাসির স্যারকে আমরা পাই ২য় বর্ষ’র শেষ দিকের থেকে, উনি তখন মাত্র জাপান থেকে PhD শেষ করে এসেছিলেন। তিনিও আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন শিক্ষক।

আমারা থিসিসটি শেষমেশ ভালো ফলাফল নিয়ে শেষ করি এবং অনেক কষ্টে নাসির স্যার ও ইবাদ স্যার ২ জনকেই খুশী করতে সক্ষম হয়।

যার ফলশ্রুতিতে, আমরা সাথে সাথেই জাপানে আরেকটি IEEE sponsored কনফারেন্সে পাবলিশ করতে সমর্থ হয়। (link: https://ieeexplore.ieee.org/abstract/document/8338587/) এছাড়াও বড় আঙ্গিকে এটিকে জার্নাল পেপারে রুপান্তরিত করা হয়েছে যা প্রকাশের অপেক্ষায় আছে।

এভাবে ৪র্থ বর্ষ শেষ হওয়ার পূর্বেই আমার ছাত্রজীবনে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সাফল্যের পাশাপাশি যুক্ত হয়ে যায় ২ টা পাব্লিকেশন।

সম্প্রতি যে NASA ঘুরে আসলাম, তা কখনো সম্ভব হতো না, যদি ইবাদ স্যার আমাকে সেমিনারে বক্তা হওয়ার জন্য আমন্ত্রন না করতেন এবং Academia School আমাকে সেখানে পছন্দ না করত।

তবে শেষ অর্জনটি হল সবার থেকে আলাদা। আমি ভার্সিটি জীবনে ইবাদ স্যারের ক্লাস করে “Photonics” এর প্রেমে পড়ে যাই।

এছাড়াও ছোটবেলা থেকে আলোর প্রতি একটা আলাদা ভালো লাগা ছিল যখন জানতে পারি মহাকাশের নক্ষত্ররাজির সৌন্দর্যের পিছনে রয়েছে তা থেকে নিঃসৃত ফোটন বা আলো।

তো আমি স্নাতকের শেষ দিকে বিভিন্ন জায়গায় উচ্চশিক্ষার্থে আবেদন করেছিলাম, গৃহীত প্রত্যাখ্যাত দুই রকমের ফলাফলই পাচ্ছিলাম।

তবে চোখ আটকে যায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন’ (ইইউ)র মাস্টার্স প্রোগ্রাম “EuroPhotonics” দেখে।

এবং এর শিক্ষা কার্যক্রম হবে “Photonics” এ নন্দিত জার্মানির “Karlsruhe School of Optics & Photonics” (KSOP), ফ্রান্সের Aix-Marseille University (AMU) এবং স্পেন এর University of Barcelona। শুরুটা হবে ফ্রান্সে, এরপর পছন্দানুযায়ী জার্মানি অথবা স্পেন।

টিউশন ফি নিয়ে ভয়ে ছিলাম, ফান্ডিং না পেলে প্রায় ২১ লক্ষ টাকা টিউশন ফি দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হতনা।

আল্লাহ্‌র অশেষ রহমতে আমি Main List এ selected হয়, ১০০% টিউশন ফি মওকুফ সহ মোবিলিটি স্কলারশীপ লাভ করি ফ্রান্স সরকারের A*Midex Foundation থেকে এবং আমার চলার পথ সুগম হয়।

এবং “EuroPhotonics” এ আবেদনের সময় আমাকে যে ৩ জন স্যার Recommendation Letter দেন শ্রদ্ধেয় ইবাদ স্যার ও তাদের মাঝে একজন।

জীবনের শুরুর দিকে সংগ্রামী আমি আজ এত সাফল্যের মুখ দেখতে পারতাম না যদি আলো হয়ে তিনি আমার জীবনে না আসতেন।

স্যার ক্লাসে একবার LASER লাইটের টপিকটি পড়াচ্ছিলেন। সেখানে তিনি বলছিলেন কিভাবে আলোককণা বা ফোটন প্রথমে ইলেকট্রনকে উদ্দীপিত করে উঁচু শক্তিস্তরে নিয়ে যায়, পরে সেটি ধীরে ধীরে নিচের শক্তিস্তরে নামার সময় আলো বিকীর্ণ করে (যার একটি স্লাইড নিচে এড করলাম)।

আপনারা যদি খেয়াল করেন তবে দেখবেন, সবুজ রঙের ঢেউগুলো হলো সে প্রথম দিককার ফোটন যারা নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে দেয় শুধুমাত্র ইলেকট্রনটি উদ্দীপিত করতে, পরে ইলেকট্রনটি নিজের থেকেই আলোক বিকীর্ণ করতে পারে।

সে ফোটনগুলো বা নির্দেশক সবুজ রঙের আলো আমাদের চোখে পড়ে না, আমরা জানতেও পারি না যে ভিতরে আসলে ঐ ফোটনগুলোর শোষণ হয়েছে। আমরা শুধু দেখতে পাই, পরে ইলেকট্রনটি থেকে বিকীর্ন হওয়া ভিন্ন তরঙ্গের ফোটন বা আলো।

শ্রদ্ধেয় ও সুপ্রিয় ইবাদ স্যার, দোয়া করি যেখানেই যাবেন, আল্লাহ্‌ যেন আপনাকে ভালো রাখেন।

অন্যকেউ ভুলে গেলেও এ অতিক্ষুদ্র ইলেকট্রন আপনাকে ও আপনার অবদান কখনো ভুলতে পারবে না স্যার, আপনি যে আমার আলোর উদ্দীপন..

Writer: Chowdhury Miftah Mahmud

EEE 14-1 (AIUB)

Aix-Marseille University (AMD)

EX- AIUB’ian