MI6 – জেমস বন্ডের এর এজেন্সি হিসেবেই যাকে আমরা চিনি

এমআই৬ এর সূচনা

হলিউড নায়ক জেমস বন্ডের কল্যাণে তার এজেন্সি এসআইএস, প্রকারান্তরে এমআই৬ বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত হয়ে উঠে।

১৯০৯ সালে উইলিয়াম মেলভিল নামক সিক্রেট সার্ভিস ব্যুরোর এক কর্মকর্তা সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা।

১৯৯৪ সালের আগ পর্যন্ত এমআই৬ নামটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায়নি। এমনকি সরকারিভাবেও স্বীকার করা হতো না সংস্থাটির অস্তিত্ব।

সিক্রেট এজেন্সিগুলোর মাঝে এটি অতি প্রাচীন। মূলত এর আদলেই তৈরি হয়েছে সিআইএ। সংস্থাটির সদর দপ্তর অবস্থিত লন্ডনের ভাউক্স হল ক্রসে।

ঐতিহাসিকভাবে বলশেভিক বিপ্লবের সময় থেকেই রাশিয়ার সাথে এমআই৬ স্নায়ু যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছে। বর্তমানে এটি পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের অবস্থানের প্রতি একটু বেশি নজরদারি করছে বলে ধারণা পাওয়া যায়।

সাধরন পরিচয়

প্রতিষ্ঠা:- ১৯০৯ (সিক্রেট সার্ভিস ব্যুরো প্রধান উইলিয়াম মেলভিল কর্তৃক)

মূল ক্ষমতা :- যুক্তরাজ্যের সরকার

সদর দপ্তর:- ভক্সহল ক্রস, লন্ডন

দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী :-উইলিয়াম হগ, এমপি

সংস্থা নির্বাহী :-স্যার জন সয়ার্স, কেসিএমজি

ইতিহাস

১৯০৯ সালে উইলিয়াম মেলভিল নামক সিক্রেট সার্ভিস ব্যুরো’র একজন কর্মকর্তা সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসেরপ্রতিষ্ঠাতা।

ব্যুরো বা দপ্তরটি নৌ এবং সেনা – এই দুই বিভাগে বিভাজন করা হয়েছিল। এগুলো হলোঃ

•বিদেশী গুপ্তচরবৃত্তি 
•অভ্যন্তরীণ গুপ্তচরবৃত্তি

এই বিভাজনের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল নৌসেনাবিভাগ।

যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, দু’টি শাখাই প্রশাসনিকভাবে রূপান্তরিত হয়ে ডাইরেক্টরেট অব মিলিটারী ইন্টেলিজেন্স সেকশন ৬ (এমআইসিক্স) হয়ে যায়।

এ নামই বর্তমানকালে সাধারণ নাম হয়ে এমআই৬ হিসেবে সর্বসাধারণ্যে পরিচিতি পেয়ে আসছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে চলাকালীন সময়কালে সংস্থাটির ভূমিকা ছিল মিশ্রতায় পরিপূর্ণ।

কারণ,জার্মানিতে তারা তাদের নিজস্ব কোন নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করতে পারেনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সামরিক বাহিনী কিংবা বাণিজ্যিক গোয়েন্দা সংস্থাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হতো।

যুদ্ধ পরবর্তীকালে

১৯২০ এর দশক পর্যন্ত কূটনৈতিক দপ্তরের সাথে নিবিঢ় সম্পর্কের মাধ্যমে সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস গড়ে উঠে।

এটি দূতাবাসসমূহে পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তার পদ তৈরী করে। ১ম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ব্রিটিশ আর্মি ইন্টেলিজেন্সের পদ্ধতিগণ উন্নয়নের জন্য এ পদের প্রয়োজন পড়েছিল।

এর ফলে সামগ্রীকভাবে কার্যসম্পাদন করা এবং কূটনৈতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো মজবুত হয়।

পরবর্তীতে সংগঠনীয় কার্যক্রম দরকার অনুযায়ী দৃঢ করতে থাকে।

প্রধান কর্মকর্তাদের নামের তালিকা

১|১৯০৯-১৯২৩
ক্যাপ্টেন স্যার ম্যানস্‌ফিল্ড কামিং
২|১৯২৩-১৯৩৯
অ্যাডমিরাল স্যার হিউজ সিনক্লেয়ার
৩|১৯৩৯-১৯৫২
মেজর জেনারেল স্যার স্টুয়ার্ট মেনজিস
৪|১৯৫৩-১৯৫৬
স্যার জন আলেকজাণ্ডার সিনক্লেয়ার
৫|১৯৫৬-১৯৬৮
স্যার রিচার্ড হুয়াইট
৬|১৯৬৮-১৯৭৩
স্যার জন রেনি
৭|১৯৭৩-১৯৭৮
স্যার মরিস ওল্ডফিল্ড
৮|১৯৭৯-১৯৮২
স্যার ডিক ফ্রাঙ্কস্
৯|১৯৮২-১৯৮৫
স্যার কলিন ফিগারস্

১০|১৯৮৫-১৯৮৯
স্যার ক্রিস্টোফার কারেন
১১|১৯৮৯-১৯৯৪
স্যার কলিন ম্যাককল
১২|১৯৯৪-১৯৯৯
স্যার ডেভিড স্পেডিং
১৩|১৯৯৯-২০০৪
স্যার রিচার্ড ডিয়ারলাভ
১৪|২০০৪-২০০৯
স্যার জন স্কারলেট
১৫|২০০৯-বর্তমান
স্যার জন সয়ার্স

এ মানুষগুলোর লিখিত বই ও জীবনী পরলে অনেক কিছু জানাবে পৃথীবীর ইতিহাস সম্পর্কে।

দুর্ধর্ষ দুইটি অভিযান:-এমআই৬

   অপারেশন অ্যান্ত্রোপোয়েড

১৯৪২ সালে নাৎসি কমান্ডার রেইনহার্ড হেড্রিককে হত্যা করার ছক কষেছিল ব্রিটেনের গুপ্তচর সংস্থা এমআই সিক্স৷

চেকোস্লোভাকিয়ায় ব্রিটেনের মিলিটারি বেস ক্যাম্প থেকে এই অপারেশেনর জন্য দুজনকে নির্বাচন করেছিল এমআই সিক্স৷ ১৯৪২ সালের ২৭ মে ঘটে সেই হত্যাকাণ্ড৷ কীভাবে ঘটানো হয়েছিল এই হত্যাকাণ্ড?

একটি ব্যস্ত রাস্তায় ট্রামের মধ্যে একেবারে জানলার ধারে বসেছিল ওই দুই এজেন্ট৷ সেই সময় ট্রামের গা ঘেঁষে এসে দাঁড়ায় কমান্ডার রেইনহার্ডের হুটখোলা গাড়ি৷

একজন এজেন্ট ট্রামের জানলা থেকে বন্দুক তাক করে গুলি ছুঁড়তে যায়, আর তখনই বন্দুকের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ট্রিগার আটকে যায়৷ সেই সময় তা দেখতে পেয়ে পালটা গুলি চালায় কমান্ডার রেইনহার্ড৷

গাড়ি থেকে নেমে পড়েন তিনি৷ আর সেই সময় আরেক এজেন্ট রেইনহার্ডের গাড়িতে গ্রেনেড ছোঁড়ে৷ প্রবল বিস্ফোরণে গাড়িটি উড়ে যায়৷

কমান্ডার রেইনহার্ড মারাত্মকভাবে জখম হন৷ সেই সময় বেঁচে গেলেও হাসপাতালে অপারেশেনর কয়েকদিন পরই তিনি মারা যান।

অপারেশন স্টপওয়াচ

সিআইএ ও এমআই৬। দ্বারা পরিচালিত একটি যৌথ অভিযান। ১৯৫০ এর দশকে বার্লিনে অবস্থিত সোভিয়েত আর্মির সদর দফতরের ল্যান্ডলাইন কমিউনিকেশনে আড়ি পাততে এ অভিযান চালানো হয়।

সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত এলাকার দিকে কাটা হয় সুড়ঙ্গ। শুরতেই সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ তাদের গুপ্তচর জর্জ ব্লেকের মাধ্যমে অপারেশনের খবর পেয়ে যায় এবং ১৯৫৬ সালে সুড়ঙ্গটি আবিষ্কার করে।

রাশিয়ার গুপ্তচরের বিশ্বাঘতকা ও এমআই৬ এর হয়ে কাজ করা:- সাংঘাতিক ঘুপ্তচর

বৃটেনে রাশিয়ার যে গুপ্তচরকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে তার কোডনাম ছিল ‘ফোর্থউইথ’। বৃটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই৬-এর কাছে তার মূল্য ছিল অপরিসীম। তিনি রাশিয়ার অনেক সামরিক গোপন তথ্য সরবরাহ করতেন বৃটিশ গোয়েন্দাদের।

রাশিয়ার এই গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপালকে নিয়ে বৃটেন ও রাশিয়ার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নতুন করে উত্তেজনা।

বর্তমানে রাশিয়ার বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার নাম জিআরইউ। এ গোয়েন্দা সংস্থার অনেক মূল্যবান তথ্যভাণ্ডার হলেন এই ৬৬ বছর বয়সী গুপ্তচর স্ক্রিপাল।

কমপক্ষে ১০ বছর ধরে তিনি ওইসব স্পর্শকাতর তথ্য সরবরাহ করে যাচ্ছিলেন বৃটেনের কাছে।

এর মধ্যে জিআরইউ-এর পুরো টেলিফোন ডাইরেক্টরি তিনি সরবরাহ করেছেন বৃটেনের গোয়েন্দাদের কাছে।

রাশিয়ান গোয়েন্দা তথ্য তিনি এমআই৬-এর কাছে প্রকাশ বা সরবরাহ করে যাচ্ছেন এটা জানার পর গুপ্তচর বিনিময়ের অধীনে ২০১০ সালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বৃটেনে।

প্রথমে স্প্যানিশ গোয়েন্দা নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথমে তাকে আবিষ্কার করে বৃটেন। ওই স্প্যানিশ গোয়েন্দা সংস্থা পরিচালনা করতো বৃটিশ গোয়েন্দারা।

মনে করা হয়েছিল, বৃটিশদের জন্য স্ক্রিপাল ভালো কাজ করতে পারবেন। ওই সময়ে স্পেনে রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা জিআরইউ’র কর্মকর্তা ছিলেন স্ক্রিপাল। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এমআই৬- এর একজন কর্মকর্তা।

বৃটিশ ওই কর্মকর্তা নিজে স্প্যানিশ ব্যবসায়ী সেজে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। স্ক্রিপালের বয়স তখন ৪৪ বছর। সময়টা ১৯৯৬ সাল।

সে সময়ে রাশিয়ান এই গুপ্তচর ও বৃটিশ গুপ্তচরের মধ্যে প্রথম সাক্ষাৎ হয়। এরপর রাশিয়ান গুপ্তচরের শরীরে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। তিনি চলে যান মস্কোতে।

তবে ঘন ঘন তিনি স্পেন যাওয়া-আসা করতেন। এ সময় এমআই৬-এর সঙ্গে তার যোগাযোগ আরো বেড়ে যায়। তিনি হয়ে ওঠেন একজন ‘ফুলটাইম’ গুপ্তচর।

রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা জিআরইউ থেকে তিনি অবসরে যান ২০০০ সালে। কিন্তু সাবেক একজন সেনা সহকর্মীর মাধ্যমে তিনি মস্কোর প্রাদেশিক সরকারে একটি চাকরি জুটিয়ে নিতে সক্ষম হন।

আর গোপনে গোপনে তথ্য পাচার করতে থাকেন এমআই৬-এর কাছে। মালাগার কাছে তিনি কিনে ফেললেন একটি হলিডে হোম।

সেখানে টানা তিনদিন তিনি গোপন তথ্য নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেন। প্রতিটি বৈঠকের জন্য, প্রতিটি ঘটনায় তিনি ৫০০০ থেকে ৬০০০ পাউন্ড পর্যন্ত অর্থ পেতেন।

সেই অর্থ জমা করতেন স্প্যানিশ একটি ব্যাংকের একাউন্টে। সূত্রগুলো বলেছেন, তার প্রথমদিককার লক্ষ্য ছিল আর্থিক।

কিন্তু আস্তে আস্তে তিনি বৃটেনের প্রতি খুব বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তবে তাকে বৃটেনে আনার পক্ষে ছিল না এমআই৬।

তারা মনে করতো এতে ‘ফোর্থউইথ’ ও গোয়েন্দা সার্ভিসের মধ্যে যোগসূত্রে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। একবার হঠাৎ করে স্পেনে এক জরুরি বৈঠক ডাকা হলো। এ জন্য তিনি নগদ ১০০০০ ডলার চেয়ে বসলেন।

পরের দিন ওই অর্থ নিয়ে সেখানে হাজির হলেন এমআই৬-এর একজন কর্মকর্তা। এসব কারণেই গোয়েন্দা সূত্রগুলো বিশ্বাস করছে, বৃটেনে এই গুপ্তচরকে এ কারণেই টার্গেট করে থাকতে পারে রাশিয়া।

কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর সব গোয়েন্দা তথ্য তিনি সরবরাহ করেছেন বৃটেনের কাছে।

এই মুহূর্তে এমআই৬-এর কমপক্ষে এক ডজন সাবেক এজেন্ট বসবাস করছেন বৃটেনে। তাদেরকে দেয়া হচ্ছে উচ্চ মাত্রার নিরাপত্তা। তাদের নাম গোপন রাখা হয়েছে।

কিন্তু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিজে ছিলেন সাবেক গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি’র একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল।

তার তো এসব গুপ্তচরের নাম, পরিচয় না জানার কথা নয়। ফলে তার শিকারে পরিণত হয়ে থাকতে পারেন স্ক্রিপাল।

বলা হচ্ছে, সের্গেই স্ক্রিপাল রাশিয়ান গোয়েন্দাবৃত্তির বিশাল তথ্যভাণ্ডার সরবরাহ নাও করে থাকতে পারেন। কিন্তু এ কথা সত্য যে, রাশিয়ার সেনা গোয়েন্দা কাঠামোর সুনির্দিষ্ট তথ্য তার দখলে ছিল।

বিশেষ করে শত শত কর্মকর্তার পরিচয় ও সংশ্লিষ্ট বিষয়। তিনি এমআই৬- এর সঙ্গে যেসব তথ্য শেয়ার করতেন তা অন্য মিত্র গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও চলে যেতো।

এমন গোয়েন্দা সংস্থা হলো যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ। সের্গেই স্ক্রিপাল জিআরইউ থেকে অবসরে যাওয়ার পরও বৃটিশ গোয়েন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।

এ বিষয়টি ধরা পড়ার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয় ২০০৪ সালে। তাকে ১৩ বছরের জেল দেয়া হয় ২০০৬ সালে। কিন্তু রাশিয়ার গ্লামারাস নারী গোয়েন্দা আনা চ্যাপম্যানকে হস্তান্তরের বিনিময়ে তাকে মুক্তি দেয়া হয়।

আনা চ্যাপম্যানকে যুক্তরাষ্ট্রে আটক করা হয়েছিল গুপ্তচরবৃত্তির জন্য।

এমআই৬ পৃথিবীর অন্যতম দুর্ধর্ষ ও শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা। কোনো কোনো সময় সিআইএ , মোসাদের সাথে এক হয়ে কাজ করে।

এমআই৬ পৃথীবীর সকল গোয়েন্দা সংস্থাকে তাদের প্রতিদ্বন্দি মনে করেন। এই আলোচনায় একদম সংক্ষিপ্তভাবে এমআই৬ কে তুলে ধরা হয়েছে।

সোর্স:-
১.উইকিপিডিয়া