বাংলাদেশের ওয়ান অব দ্য মোষ্ট সাকসেসফুল স্ট্রাটেজি: প্রাণ

প্রাণের পণ্যের মান নিয়ে যে যাই বলুক না কেন, ঠান্ডা মাথায় একেবারে নিউট্রাল পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখতে গেলে, প্রাণের মার্কেটিং ও প্রডাক্ট স্ট্রাটেজি বাংলাদেশের ওয়ান অব দ্য মোষ্ট সাকসেসফুল স্ট্রাটেজি। কিভাবে বলছি –

১) প্রডাক্ট পোর্টফোলিও এক্সপানসনঃ

প্রানের প্রডাক্ট লাইনে এখন প্রায় আড়াইশ রকমের পন্য রয়েছে, এবং এই সংখ্যাটা প্রায় প্রতি মাসেই বাড়ছে। বাজারে হয়তো এমন পন্য আপনি দেখেছেন ও ব্যবহারও করেছেন, কিন্তু হয়তো আপনি জানেও না যে ওটা প্রাণের পন্য।

প্রাণ অন্য ১০টা কোম্পানির মত প্রডাক্ট পোর্টফোলিও বানায় না। অন্য ১০টা কোম্পানি একটা করে পন্যকে বাজারে ছাড়ে, সেটাকে নার্চার করে, ব্র্যান্ডিং করে। অপরদিকে, প্রাণ একই ভেরিয়েন্টে ১০ টা ব্র্যান্ড বাজারে ছাড়বে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে, খুব এগ্রেসিভলি, তারপর দেখবে কোনটা ক্রেতাদের কাছে বেশী গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।

তারপর সেটাকে ব্র্যান্ডিং করা শুরু করবে। বাকীদের বাজার থেকে হারিয়ে যেতে দেবে (যেমনঃ জিরা পানি) কিংবা নীশ বাজারে ছাড়বে (যেমনঃ ম্যাক্স কোলা)। আমার মনে হয়, প্রডাক্ট পোর্টফোলিও এক্সপানসনের এটা যথাযথ ও যুক্তিসংগত উপায়।

প্রসংগত বলে রাখি, আমাদের একেবারেই দেশীয় কিছু খাবার আছে, যেগুলো খুব সম্ভবত প্রাণই প্রথমবারের মত সুন্দর মোড়কে ও কোরপোরেট ব্র্যান্ডের অধীনে এনেছে। যেমনঃ শনপাপড়ী, আমসত্ব, ঝালমুড়ি ইত্যাদি।

২) ডিসট্রিবিউশান চ্যানেলঃ

আমার ধারনা, বাংলাদেশে যতগুলা কনজুমার ব্র্যান্ড আছে তার ভেতর প্রাণের ডিসট্রিবিউশান চ্যানেল সবচাইতে শক্তিশালি, এমনকি ইউনিলিভারের চাইতেও।

বছর দুয়েক আগে আমি কেওকারাডং এর চূড়ায় উঠতে যাই, তখন সেখানে যাবার পথে একটা গ্রামে বিশ্রাম নিতে থেমেছিলাম। অনেক উচুঁ পাহাড়ের উপর আদীবাসীদের ছোট্ট একটা গ্রাম। সেই গ্রামে একটাই মাত্র মুদি দোকান। সে দোকানেও আমি প্রাণের চানাচুর আর পটেটো চিপস দেখতে পেয়েছি।

বাদ বাকী সব পন্য মায়ানমারের। প্রাণ যদি আজ সকালে নতুন এক হাজার টাইপ পন্য বাজার জাত করে, আপনি আগামীকাল সকালের ভেতর ঐ প্রত্যন্ত এলাকাতেও সেগুলো পেয়ে যাবেন। এইটা যে কি ভীষন একটা স্ট্রেংন্থ, এটা যাদের নাই তারা বোঝে!

৩) মার্কেট প্রেজেন্সঃ আমার ধারনা, প্রাণের এ বিষয়ে স্ট্রাটেজি হচ্ছে, নিজেদের টোটাল কর্পোরেট ব্র্যান্ডকে প্রতিষ্ঠিত করা, নিজেদের নির্দিষ্ট কোন ক্যাটাগরি বা ভেরিয়েন্ট ব্র্যান্ডকে না।

যেমনঃ মুদি দোকানে গেলে একটা বড় অংশ জুড়ে আপনি প্রাণের পন্যই পাবেন। বিভিন্ন টাইপের পন্য, কিন্তু সবই প্রাণের পন্য। আর প্রাণের লক্ষ্যই এটা, দোকানের একটা সেলফের দখল নিয়ে নেয়া। ক্রেতা চিপস থেকে শুরু করে সস, জুস কিংবা বিস্কুট যাই কিনুক না কেন, সেটা যেন প্রাণেরই হয়। আর প্রাণ এই স্ট্রাটেজিতে সফল।

৪) মার্কেট শেয়ারঃ

প্রাণের মার্কেট শেয়ার কনজুমার প্রোডাক্টে ওয়ান অব দ্য হায়েস্ট। প্রাণ একই ধরনের পণ্যের কয়েকটা ভিন্ন ভিন্ন ব্র্যান্ড একসাথে লঞ্চ করে, এতে করে দ্রুত মার্কেট শেয়ার বাড়ে। আর যদি এর কোনটা হিট হয়ে যায়, তাহলে তো কথাই নেই। ধরেন, বাজারে চানাচুরের তিনটা আলাদা আলাদা ব্র্যান্ড আসলো, আলাদা আলাদা নামে ও প্যাকেজিংয়ে।

প্রাণের মারাত্নক শক্তিশালী প্রডাক্ট ডিসট্রিবিউশন চ্যানেলের কারণে সেটা সে দুদিনের ভেতর সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিলো। এখন দেশের কোন না কোন অঞ্চলে ঐ তিনটা ব্রান্ডের কোন না কোন ব্র্যান্ড হিট হবে। আর যেটাই হিট না কেন, তাতেই প্রাণের লাভ কারণ তিনটাই আলটিমেটলি প্রাণেরই ব্র্যান্ড।

৫) প্রাণের উপর মুদি দোকানগুলোর নির্ভরশীলতাঃ

একটা মুদি দোকানে প্রাণের পন্য যদি না চলে তবে সে দোকানই মুটামুটিভাবে অচল। আর প্রাণ যদি কোন দোকানে তাদের পন্য সরবরাহ করা বন্ধ করে দেয়, তবে সে দোকানও হুমকির মুখে পড়বে। এই নির্ভরশীলতা তৈরী হয়েছে প্রাণের প্রাইসিং স্ট্রাটেজির জন্য।

ভারতীয় উপমহাদেশের লোকেরা জাতি হিসেবে Cost-focused nation, not quality-focused, unlike Europe-USA. এখানে আপনি পণ্যের গুনগত মান কমিয়ে হলেও তুলনামূলক সস্তা পন্য মানুষকে দিয়ে কেনাতে পারবেন। প্রাণ এটাই করেছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মানুষজন সস্তায় প্রাণের পন্য কিনতে পারছে, যেটাতে তারা তৃপ্তও হচ্ছে।

প্রাণের কোয়ালিটি নিয়ে হয়তো আপনি-আমি কথা বলি ,কিন্তু তৃণমূলের কনজিউমাররা কিন্তু প্রাণের মান নিয়ে সন্তুষ্ট! আর তারাই হচ্ছেন ম্যাস পিপল, যারা এই দেশের মোট জনসংখ্যার একটা বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব করেন। সুতরাং, তারা তৃপ্ত মানে ওভারওল প্রাণ কনজুমার ব্র্যান্ড হিসেবে সাকসেসফুল!

৬) প্রাণের প্রতিষ্ঠিত কিছু ব্র্যান্ডঃ

তাহলে প্রাণ কি শুধু পন্য বিক্রিই করে গেছে? সফল ব্র্যান্ড কি প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি? অবশ্যই পেরেছে। যেমনঃ

ক) RFL: এই দেশের অত্যন্ত সফল এক প্লাস্টিক ফার্নিচার ব্র্যান্ড, পন্যের মানও যথেষ্ঠ ভালো। এর আগে তানিন ছিলো এই সেগমেন্টে, কিন্তু পারে নাই উঠতে তেমন। অথচ আরএফলএল উঠে গেছে। প্রতি বছর বাণিজ্য মেলায় তাদের স্টলে ক্রেতা উপচে পড়ে। তাদের প্লাস্টিকের মান খারাপ এমন অভিযোগ আমি এখনো পাইনি।

খ) মিঃ নুডুলসঃ প্রাণের একটি শক্তিশালী ফুড ব্র্যান্ড। এর মান খারাপ আমি এখনও শুনিনি।

গ) টেস্টি ট্রিট: প্রাণের এই ফাস্ট ফুড ও বেকারী ব্র্যান্ডটা গতবছর থেকে বেশ ভালো করছে। এদের প্রডাক্ট কোয়ালিটি ও কাস্টমার সার্ভিসে আমি যথেষ্ঠ সন্তুষ্ট। বিশেষ করে এর কেক ও মোমো অনবদ্য। এত অল্প দামে এত ভালো পন্য আসলেই আশাতীত ছিলো।

ঘ) মিঠাইঃ প্রাণের এই মিষ্টির ব্র্যান্ডটাও বাজারে বেশ নাম করতে শুরু করেছে।

ঙ) প্রাণ ড্রিংকিং ওয়াটারঃ উপজেলাগুলোতে এটা বেশ স্ট্রং ব্র্যান্ড। সুনামগঞ্চের মফস্বল শহরে আমি এমনও টং দোকান দেখেছি, সে দোকান শুধুমাত্র প্রাণের পানির বোতল বিক্রি করে, তার দোকানে আর পন্য নেই।

একটাই পন্য আর সেটা প্রাণের পানির বোতল। এবং দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। আমার দাদু বাড়ী টাংগাইলেও দেখেছি, পানির বোতল মানেই প্রাণ নয়তো মাম। বাদ বাকীর খুব একটা পাত্তা নেই।

চ) প্রাণের ডাল ভাজাঃ এটা আমার পারসোনালি ফেভারিট ব্র্যান্ড। রুচি এবং প্রাণ – উভয়ের ডাল ভাজাই আমার কাছে সমান স্বাদের লেগেছে। সে তুলনায় প্রাণের ডাল ভাজা রুচির চাইতে সস্তা ও অনেক বেশী সুলভ। ঢাকায় এমন কোন মুদি দোকান নাই যেখানে আপনি প্রাণের ডাল ভাজা পাবেন না। প্রাণের চানাচুরও কয়েকবার কিনেছি, কখনো মান খারাপ বলে মনে হয়নি।

ছ) অল টাইমঃ এই ব্র্যান্ডের অধীনে প্রাণের প্রায় শ খানেক পন্য আছে। যে রিকশাওয়ালা এতদিন ৫ টাকা দিয়ে প্যাকেটবিহীন ব্রেড খেতো, সে কিন্তু এখণ হানিকম্ব ব্রেড প্রায় একই দামে কিনে খেতে পারছে, সাথে পাচ্ছে সুন্দর মোড়ক, যার কারণে তার কাস্টমার স্যাটিসফিকশন বাড়ছে।

গ্রামের দিকেও “অলটাইমকে” তারা অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। যে গ্রামে আপনি কোন প্যাকেটজাত বান খুঁজে পাবেন না, সেখানে অলটাইমের বানই ভরসা। খুব সম্ভবত, অলটাইমের বান দেশের পয়লা নম্বর বেকারী ব্র্যান্ড, ইন টার্মস অফ মার্কেট শেয়ার।

জ) PRAN UHT Milk : এটি ২০১৬ সালে বেষ্ট ব্র্যান্ড এর কাতারে ২য় স্থান করে পুরস্কার পায়।

৭) দেশ ও সমাজে অবদানঃ

প্রাণের কারণে এ দেশের আপামর মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন হয়েছে। ওয়ালটন আজ যে ভিশন নিয়ে পরিচালিত হয়েছিলে, সেটা আদতে তাদের আগে প্রাণ চালু করেছিলো। এবং তারা সফলভাবে এই দেশের মানুষের জীবনযাত্রা বদলে দিয়েছে।

প্রাণ বাংলাদেশের মাল্টি বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি। প্রাণ গত অর্থবছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা কামিয়েছে শুধুমাত্র রপ্তানিখাত থেকে। প্রায় ১১০ টি দেশে এটি পন্য রপ্তানি করে থাকে।

এটির মার্কেট ক্যাপিটাল প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের প্রাণ আরএফএলের ৩ টা ইন্ড্রাসট্রিয়াল পার্ক আছে (গাজীপুর, রংপুর আর নরসিংদীতে), আর ১৯ টা ফ্যাক্টরি আছে দেশজুড়ে। ২০০২ সালে বানানো রংপুরের ইন্ড্রাসট্রিয়াল পার্কের মাধ্যমে তাদের রাজত্ব শুরু হয় এই দেশে।

শুরুতে তারা শুধুমাত্র টিউব ওয়েল আর সেচ কাজের জন্য পানির মোটর উৎপাদন শুরু করলেও আজ প্রায় প্রতিটা রিটেইল সেক্টরেই তাদের পদচারনা। চিন্তা করেন, টোটাল ২৩ টা ফ্যাক্টরি, কি বিপুল পরিমান মানুষ এতে কাজ করে? কি বিপুল পরিমান মানুষ প্রাণের ডিসট্রিবিউশান চ্যানেলের সাথে জড়িত থেকে উপার্জন করছেন?

প্রাণকে বিশেষ ধন্যবাদ এই দেশের টমোটো প্রডাকশনকে ঠিকঠাকমতো কাজে লাগাবার জন্য, একাধিক জেলায় টমেটো প্রক্রিয়াজাত করে টমেটো সস বানাবার কারখানা স্থাপন করার জন্য। কয়েক বছর আগেও টমোটো চাষীরা খুব বিপাকে ছিলো।

সারা বছর প্রচুর টমোটো উৎপাদিত হতো কিন্তু সে পরিমান ক্রেতা না থাকায় প্রতি বছরই শত শত টন টমেটো পচে গলে নষ্ট হয়ে যেতো।

প্রাণ এখন সস্তা দরে চাষীদের কাছ থেকে টমেটো কিনে নিজেদের বানানো নিকটস্থ কারখানায় সেই টমেটো প্রসেস করে প্যাকেটজাত সস ঢাকায় এনে বিক্রি করে। এতে করে গ্রামবাসীদের কর্মসংস্থান যেমন হচ্ছে, তেমনি চাষীরা বেঁচেছে তাদের শষ্য নষ্ট হয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবার অভিশাপ থেকে।

লেখকঃ সাবেক কর্মকর্তা, হাংরি নাকি