বিশ্বসাহিত্য ভাষণ ১ঃ দস্তয়েভস্কির প্রকৌশলী থেকে সাহিত্যিক হয়ে ওঠা

ফিওদোর মিখায়েলোভিচ দস্তয়েভস্কি

দস্তয়েভস্কি। পুরো নাম ফিওদোর মিখায়েলোভিচ দস্তয়েভস্কি। বাঙালিরা ডাকেন দস্তোয়ভোস্কি। কিন্তু সঠিক উচ্চারণ হবে— দ-স্তাইয়েব-স্কি। পেশায় ছিলেন প্রকৌশলী।

প্রকৌশলী হিশেবে ভালো আয়ও করতেন, কিন্তু স্বভাব ছিলো আমাদের মতো, বিশ টাকা আয় করলে চল্লিশ টাকার বিলাসিতা করতেন। তবে তাঁকে লেখক বানিয়েছিলো জুয়া খেলা। জুয়া খেলে ভিখেরি হয়েছিলেন বলেই শুরু করেছিলেন লেখালেখি। আশা ছিলো, বই বিক্রি হলে কিছু অতিরিক্ত টাকা আসবে।

তাঁর পড়াশোনোর পরিধি বড় ছিলো। শুরুতে ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্যের কিছু বই অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু বাজারে তেমন কাটে নি। ভালো বই বাজারে কাটবে না, এটিই স্বাভাবিক। এর মধ্যে বালজাকের Eugénie Grandet-ও ছিলো।

বালজাকের প্রভাব, আমি দস্তয়েভস্কির বহু লেখায়, বিশেষ করে প্রথম দিকের লেখাগুলোয় লক্ষ করেছি। তবে তাঁকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিলেন গোগল ও পুশকিন।

এ প্রভাব একসময় কেটে যায়, কিন্তু তখন তাঁর লেখায়, এক-দুইজনের বদলে প্রভাব আসে বহুজনের। স্কট ডিকেন্স, অগাস্তিন, ভিক্টর হুগো, এলান পো, হারজেন, কান্ট, বেলিনস্কি, লর্ড বায়রন, প্লেটো, শিলার, সারভান্তেস, বাকুনিন, সলোভিয়ভ, হেগেল, লারমান্তোভ, শেক্সপিয়ার, হোমার, হফম্যান, ও আরও অনেকের লেখা ও চিন্তা, দস্তয়েভস্কির লেখা ও চিন্তাকে প্রভাবিত করেছিলো। মানুষের সাইকোলোজিক্যাল টেনশন, তাঁর লেখার প্রধান উপজিব্য ছিলো।

হ্যাঁ, শুধু দস্তয়েভস্কিই প্রভাবিত হয়েছিলেন, কিন্তু দস্তয়েভস্কি কাউকে প্রভাবিত করেন নি, ব্যাপারটি এরকম নয়। জাঁ পল সাঁত্রের যে-এক্সিসটেনশিয়ালিজম, সেটির জন্ম হয়েছিলো দস্তয়েভস্কির হাত ধরে। তাঁর ‘নোটস ফ্রম দা আন্ডারগ্রাউন্ড’ পড়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন জার্মান দার্শনিক নিটশা, যিনি এক্সিসটেনশিয়ালিজমকে, সাঁত্রের আগেই একটি কাঠামো দান করেছিলেন।

ফ্রয়েডের যে-সাইকোএনালাইসিস, তার প্রাথমিক ধারণাও, আমি মনে করি দস্তয়েভস্কি থেকেই নেয়া। শোলজিনিৎসিন এবং চেখভ, এ দুজনও দস্তয়েভস্কি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

তবে পৃথিবীর নানা অঞ্চলে, দস্তয়েভস্কি বিভিন্ন মহামনীষীদের প্রভাবিত করলেও, বাংলাভাষী অঞ্চলে প্রভাবিত করেছেন হুমায়ূন আহমেদ, সুনীল গঙ্গোপাধায়, ও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে।

দস্তয়েভস্কি ও তাঁর দ্বারা প্রভাবিত অন্য ভাষার লেখকেরা, যেখানে নির্মাণ করেছেন পর্বত, সেখানে আমাদের তিনজন নির্মাণ করেছেন উঁইপোকার ঢিবি। হিমু নামের যে-ভবঘুরে চরিত্রটি এ অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়েছে, এ চরিত্রটি দস্তয়েভস্কির কিছু এক্সিস্টেনশিয়াল ক্যারেক্টারের হাত-পা-মাথা কেটে বানানো হয়েছে। ‘আজ রবিবার’ নাটকে আনিস নামের যে-গর্দভটি আছে, সেটিও দস্তয়েভস্কির ‘দ্য ইডিয়ট’ উপন্যাসের মিশকিনের আদলে গড়া।

দস্তয়েভস্কির প্রথম উপন্যাস ‘বিয়েদনি লুদি’, ইংরেজিতে ‘Poor Folk’, বাংলায় বলা যেতে পারে ‘গরিব মানুষ’, লেখা হয় ১৮৪৫ সালে। গ্রিগোরোভিচ নামে তাঁর একজন রুমমেট ছিলেন, যিনি একদিন উপন্যাসটি কবি নিকোলাই নেক্রাসোভের কাছে নিয়ে যান। নেক্রাসোভ আবার এটিকে নিয়ে যান বেলিনস্কির কাছে।

বেলিনস্কি উপন্যাসটিকে দেখে মন্তব্য করেছিলেন— এটি রুশ ভাষার প্রথম সামাজিক উপন্যাস। দস্তয়েভস্কি এটিতে দরিদ্র মানুষদের জীবন, খুব রোম্যান্টিক, কিন্তু রিয়েলিস্টিকভাবে উপস্থাপন করেছিলেন।

বাংলা সিনেমা ও অপন্যাসগুলিতে, ধনী বাবার রূপসী কন্যাদের সাথে, ভ্যানচালক ও ভবঘুরে যুবকদের যে-প্রেম-ভালোবাসা দেখা যায়, তার কিছুটা, আমার ধারণা দস্তয়েভস্কির ওই ‘গরিব মানুষ’ উপন্যাস থেকে এসেছে। বাখতিন যে-পলিফোনিক স্টাইলের গদ্যের কথা বলেছিলেন, তার অস্তিত্ব, দস্তয়েভস্কির অন্য উপন্যাসগুলোর মতো এ উপন্যাসেও পাওয়া যায়।

তবে এ উপন্যাসে, গোগল, পুশকিন, ও কারামজিন, এ তিনজনের লেখার স্টাইল, ও বর্ণনারীতি, আমার সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে। এটি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, কারণ গরুর দুধ বা হরলিক্স নয়, লেখকেরা প্রভাবিত হন অন্য লেখকদের লেখা ও চিন্তা দ্বারা।

উপন্যাসটি বাজারে খুব আলোড়ন ফেলেছিলো। এর কারণ সম্ভবত, উপন্যাসটির থিম ছিলো হিউম্যানিট্যারিয়ান। এর প্রধান চরিত্র দুটি, দেবুশকিন ও দেব্রোসিলোভা, চিঠি চালচালির মাধ্যমে, পাঠক যা শুনতে চায় তা শোনাতে পেরেছিলো। তবে আমি মনে করি, লিটারারি ন্যাচারালিজমের যে-বৈশিষ্ট্যগুলো কোনো লেখায় থাকলে মানুষ সহজে আকৃষ্ট হয়, সে-বৈশিষ্ট্যগুলো উপন্যাসটিতে ছিলো বলেই এটি জনপ্রিয় হয়েছিলো।

সমালোচকেরাও উপন্যাসটির প্রশংসা করেছিলেন। যদিও কেউ কেউ, অতিরঞ্জিত মন্তব্যও করেছিলেন। যেমন আলেকজান্ডার হারজেন। হারজেন তো উপন্যাসটিতে সোশ্যালিজম বা সমাজবাদিতার ছায়াও খুঁজে পেয়েছিলেন!

তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দিভায়নিক’, ইংরেজিতে ‘দি ডাবল’, প্রকাশিত হয় ১৮৪৬ সালে। উপন্যাসটিতে তিনি গোগলকে এতো দৃষ্টিকটুভাবে নকল করেছিলেন যে, বাধ্য হয়ে এটিকে সংশোধন করেন, এবং পুনঃপ্রকাশ করেন ১৮৬৬ সালে। এটির ১৮৪৬ সালের একটি সংস্করণ আমি পড়েছি, এবং পড়ে মনে হয়েছে যে গোগলের জন্ম না হলে দস্তয়েভস্কির জন্মও হতো না।

উপন্যাসটির নামের সাথে যে-উপনামটি আছে, উপনামটি আমি এখানে উল্লেখ করে দিচ্ছি— ‘আ পিটার্সবুর্গ পোয়েম’, সেটি আমাকে গোগলের ‘দি ডেড সোওল’-এর কথা মনে করিয়ে দেয়, আর উপন্যাসটির ভেতরের পাতা উল্টালে মনে হয়, এটি গোগলের ‘দি ওভারকোট’-এর দস্তয়েভস্কীয় সংস্করণ। গোগলের ‘পিটার্সবুর্গ টেইলস’গুলোর সাথেও এর নানা মিল লক্ষ করা যায়।

তবে এটি সম্ভবত দস্তয়েভস্কির লেখা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, যদিও সাধারণ পাঠকেরা উপন্যাসটির কথা তেমন জানেন না। এর কারণ হলো, এটি তিনি লিখেছিলেন বিখ্যাত হওয়ার অনেক আগে।

উপন্যাসটিতে দস্তয়েভস্কি, জেমস জয়েস স্টাইলে প্রতিটি ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন, এবং এর ভাষাভঙ্গি ছিলো খুব গাঢ় ও গতিশীল। নবোকভ তো এ উপন্যাসটির কাছে, দস্তয়েভস্কির অন্যান্য উপন্যাসগুলিকে তুচ্ছ বলেছেন।

এখানে আমি আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। ‘দি ডাবল’ উপন্যাসটির যে-প্রধান চরিত্র, নাম গোলিয়াদকিন, সে ছিলো, আমার ধারণা সিজোফ্রেনিয়ার রোগী। কারণ সে প্রায়ই হেলুসিনেশনের শিকার হতো। আমাদের হুমায়ূন আহমেদ দস্তয়েভস্কি পড়তেন, এবং হুমায়ূন আহমেদের বহু লেখায় এই হেলুসিনেশনের ব্যাপারটি এসেছে।

আমার সন্দেহ, হেলুসিনেশনকে পপুলারাইজড করার চিন্তাটি, হুমায়ূন সম্ভবত দস্তয়েভস্কি থেকে প্রথম নিয়েছিলেন, এবং ফ্রয়েড থেকে পাকাপোক্ত করেছিলেন। পার্থক্য শুধু, দস্তয়েভস্কি যেখানে নির্মাণ করেছেন আর্ট বা শিল্প, হুমায়ূন সেখানে শুধু ছাপিয়ে গেছেন বইয়ের পর বই।

দস্তয়েভস্কির জীবনী আমি এখানে আলোচনা করবো না, কিন্তু কিছু বিষয় উল্লেখ করা জরুরী। না হলে, আমার কিছু বক্তব্য বুঝতে আপনাদের অসুবিধা হবে।

তাঁর জন্ম— ১১ নভেম্বর, ১৮২১ সালে, মস্কোতে। মৃত্যু— ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮১ সালে, সেন্ট পিটার্সবুর্গে। বেঁচেছিলেন ৫৯ বছর। ১৫ বছর বয়সে মা’কে হারান। বাবা ছিলেন চিকিৎসক। পড়াশোনো করেছেন একটি মিলিটারি একাডেমিতে।

বিষয় ছিলো প্রকৌশল। সেখানে তিনি সাহিত্যও পড়েছেন। তবে দস্তয়েভস্কি, এই একাডেমির জীবনকে খুব একটা পছন্দ করেন নি। তাঁর চলাফেরাও সেনাসদস্যের মতো ছিলো না। কিন্তু তিনি সাহসী ছিলেন, তাঁর বিবেচনাবোধ উন্নত ছিলো। দরিদ্র চাষীদের প্রতিও তাঁর সহমর্মিতা ছিলো, এবং তিনি দুর্নীতির সমালোচনা করতেন।

একাডেমি থেকে পাশ করার পর কিছুদিন ঘুরে বেড়ান এখানে ওখানে। কনসার্ট, ওপেরা, নাটক ইত্যাদি উপভোগ করেন, এবং এ সময়ে, দুই বন্ধুর মাধ্যমে তাঁর পরিচয় ঘটে জুয়া খেলার সাথে। এরপর লেফটেন্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার হিশেবে চাকুরি শুরু করেন।

কিন্তু বেহিশেবী বিলাসিতা, আর জুয়া খেলার অভ্যাসের কারণে আর্থিক টানাপোড়ন লেগেই থাকতো। সাহিত্যের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে তিন বছর বয়স থেকে। এলেনা নামে তাঁর একজন দেখাশোনাকারী ছিলেন, যিনি তাঁকে নিয়মিত গল্প শোনাতেন।

তাঁর বাবা-মা দুজনেই প্রচুর বই পড়তেন। তাদের মধ্যমেই শৈশবে, দস্তয়ভস্কির পরিচয় ঘটে দেরজাবিন, কারামজিন, পুশকিন, রাডক্লিফ, গোগল, শিলার, ও গ্যাটের লেখার সাথে। সারভান্তেস, যিনি ডন কুইক্সাট লিখেছিলেন, তাঁর লেখার সাথেও দস্তয়েভস্কির তখন থেকেই পরিচয়।

দস্তয়েভস্কি ছিলেন গোঁড়া খ্রিস্টান। এ কারণে বেলিনস্কির সাথে তাঁর সম্পর্কের অবনতি হয়েছিলো, কারণ বেলিনস্কি ছিলেন নাস্তিক। কিন্তু বেলিনস্কির কাছ থেকেই দস্তয়েভস্কি প্রথম সমাজবাদিতার দর্শন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন।

এ সময় তিনি কিছু, ফরাসি সমাজবাদী লেখক দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে ফুরিয়া, ক্যাবে, ও ক্লদ সিমো উল্লেখযোগ্য। আমার ধারণা, দরিদ্র ও নিপীড়িতদের প্রতি তাঁর যে-সহমর্মিতা ছিলো, সেটিই তাঁকে সমাজবাদীতার দিকে আগ্রহী করে তুলেছিলো।

প্রথম উপন্যাস ‘গরিব মানুষ’ প্রকাশের পরপরই বুঝতে পারেন, চাকুরিতে থেকে তাঁর লেখালেখি করা সম্ভব হবে না। এজন্য তিনি, দ্বিতীয় উপন্যাস প্রকাশ করার আগেই সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু দ্বিতীয় উপন্যাসটি তেমন বিক্রি হয় নি, ফলে তিনি আবার পতিত হন অর্থকষ্টে। রাশিয়ায় তখন, লেখকদের কিছু ছোট ছোট ক্লাব বা সংঘ ছিলো, যেগুলোকে ডাকা হতো ‘সার্কেল’।

দস্তয়েভস্কি এরকম কয়েকটি সার্কেলে যোগ দিয়েছিলেন। এর একটি ছিলো ‘পেত্রাশেভস্কি সার্কেল’। এই সার্কেলের লাইব্রেরি ব্যবহার করে, দস্তয়েভস্কি তাঁর পড়াশোনোর পরিধি আরও বাড়াতে থাকেন। কিন্তু এই সার্কেলটি, একদিন নজরে পড়ে পুলিশের। পুলিশ, দস্তয়েভস্কি ও অন্যান্য লেখকদের গ্রেপ্তার করে। পুলিশের দাবি, এরা সম্ভাব্য বিপ্লবী।

দস্তয়েভস্কির উপর অভিযোগ আনা হয়, তিনি নিষিদ্ধ বইপত্র পড়েছেন! কী নিষিদ্ধ বই? যেমন বেলিনস্কির ‘লেটার টু গোগল’! বই ও লেখক, চিরকালই ক্ষমতাধরদের শত্রু ছিলো, দস্তয়েভস্কিও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না।

গ্রেপ্তারকৃত সবাইকে, আদালত মৃত্যুদণ্ড দিলো (আদালতগুলোর কাজই সম্ভবত ক্ষমতাবান মানুষদের ইচ্ছা পূরণ করা)। নির্দেশ দেয়া হলো, ফায়ারিং স্কোয়াডে এদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। এরা বই পড়ে ফেলেছে, বিরোধী মতের বই, এ অপরাধ মার্জনীয় নয়! বেঁচে থাকলে এরাও বিরোধী মতের বই-ই লিখবে, সুতরাং এদের মেরে ফেলাই ভালো। আদালতের কাজ আদালত করেছে, রাজার ইচ্ছাকে তারা সম্মান জানিয়েছে, এখন বাকিটা রাজা নিকোলাসের হাতে।

নিকোলাস কী মনে করে যেন (সম্ভবত কোনো ভালো মানুষ তাঁকে বুঝিয়েছিলো), মেরে ফেলার আগ মুহুর্তে দস্তয়েভস্কিদের মৃত্যুদণ্ড মাফ করে দিলেন, এবং আদেশ দিলেন, মৃত্যুদণ্ডের বদলে কারাদণ্ড ভোগ করার। এ কারাদণ্ড সাধারণ কারাদণ্ড নয়, এ দণ্ড সাইবেরিয়ার প্রিজন ক্যাম্পগুলোতে দাসের মতো রাতদিন খাটার কারাদণ্ড। এরচেয়ে এক মিনিটের গুলিতে মরে যাওয়া ভালো।

দস্তয়েভস্কির এ বন্দী জীবন, যে-জীবন খাঁচায় আটকা শুয়োরের জীবন থেকে উৎকৃষ্ট ছিলো না, তাঁর লেখায় নানাভাবে এসেছে। তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, রাজনীতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস, তাঁর চিন্তা ও লেখার গতিকে নানা সময়ে প্রভাবিত করেছে। এমন কি তাঁর বাবার মৃত্যুও তাঁর উপন্যাসগুলোর কিছু চরিত্রকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে (অনেকের ধারণা, স্ট্রোকে নয়, তাঁর বাবাকে খুন করা হয়েছিলো)।

আমি তাঁর জীবন নিয়ে আর কথা বাড়াবো না। বাড়ালে আমাকেও, বাংলা ভাষার অন্যান্য লেখকদের মতো, তাঁর দাড়ি ও চা খাওয়া নিয়ে আলোচনা করতে হবে, যা আমার উদ্দেশ্য নয়।

তাঁর কারাবাসের অভিজ্ঞতা, তিনি বর্ণনা করেছেন ‘দি হাউজ অব দি ডেড’ উপন্যাসে। রাশিয়ার ইতিহাসে, কারাগার নিয়ে লেখা এটিই প্রথম উপন্যাস। কারাগারের ভেতরেও যে মানুষের একটি সমাজ আছে, আর বাহিরের মুক্ত সমাজের সাথে ওই সমাজের যে একটি বড় পার্থক্য আছে, তা দস্তয়েভস্কি এ উপন্যাসে চিত্রিত করেছেন।

উপন্যাসটি লেখা অনেকটা ধারাভাষ্যের ভঙ্গিতে। আলেকজান্ডার পেত্রোভিচ নামের এক কয়েদির কন্ঠে, দস্তয়েভস্কি যেন তাঁর নিজের কন্ঠগুলোকেই উচ্চারণ করেছেন। এটি পড়ে তলস্তয় জেনেছিলেন, পৃথিবীতেই নরক আছে। দস্তয়েভস্কির এটিই একমাত্র উপন্যাস, যেটির প্রশংসা তলস্তয় করেছিলেন। তবে এর কিছু কিছু চরিত্রের আচরণ, আমার কাছে রিয়েলিস্টিক মনে হয় নি।

মনে হয়েছে, কিছু চরিত্র আঁকতে দস্তয়েভস্কি আশ্রয় নিয়েছেন ফিকশনের। এটি দোষের কিছু নয়, কারণ এটি কোনো ডায়েরি নয়। স্মৃতি বিস্মরণের ঘটনা একটু আধটু ঘটতে পারে। কিন্তু কারাগার যে জীবিত মানুষদের কবরখানা, এবং ক্ষমতাধর মানুষেরা যে ক্ষমতাহীন মানুষদের কষ্ট দেয়াটাকে খুব উপভোগ করেন, এর একটি অসাধারণ বর্ণনা প্রকাশ করার জন্য দস্তয়েভস্কিকে আমি বাহ্বা দেবো। আমার তো মনে হয়, এটি পড়েই শোলঝিনিৎসিন ‘দি গুলাগ আর্কিপেলাগু’ এবং ‘দি ফার্স্ট সার্কেল’ লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।

এখানে আমি আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। কোনো দেশের সাহিত্যের উন্নতির জন্য কিছু নিরন্তর উন্নয়ন-কর্ম লাগে। এ উন্নয়ন-কর্ম ইট-পাথরের নয়, লেখার। দস্তয়েভস্কি যদি ‘দি হাউজ অব দি ডেড’ নামক স্মৃতিকথাটি না লিখতেন, তাহলে আমরা হয়তো বঞ্চিত হতাম ‘দি গুলাগ আর্কিপেলাগু’-র মতো মহাগুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস থেকে।

এক লেখক অনুপ্রেরণা যোগাবেন আরেক লেখককে, সাহিত্য এভাবেই এগিয়ে যায়। পুরষ্কার বা প্রশংসা সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যায় না। মরণ একাডেমি যদি আরও একশো বছর কিছু বানরকে পুরস্কৃত করে, তাতে মরণ সাহিত্যের কোনো উন্নতি ঘটবে না, যদি না তারা সঠিক পথটিতে নজর দেয়।

এবার আসি আমি দস্তয়েভস্কির সেই বিখ্যাত বা জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোর প্রসঙ্গে। জনপ্রিয় সবকিছুই মাঝারি, বা নিম্ন-মাঝারি মানের হয়, এ সত্যটি আমি একটু পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই। ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ দিয়েই শুরু করি।

দস্তয়েভস্কি উপন্যাসটি লিখেছিলেন টাকার জন্যে, এবং উদ্দেশ্য যদি কেবল টাকা উপার্জন হয়, তাহলে যে কোনো বড় শিল্পকর্ম সৃষ্টি হয় না, তার একটি বড় প্রমাণ এই ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’। তখন তিনি দেনায় জর্জরিত, চারদিকে পাওনাদারদের উৎপাত।

বাধ্য হয়ে চিঠি লিখেছিলেন কাতকোভকে (মিখাইল কাতকোভ)। কাতকোভকে বলেছিলেন, আমাকে কিছু টাকা দিন অগ্রীম, আমি আপনাকে একটি উপন্যাস লিখে দেবো। কাতকোভ তখন ‘দি রাশিয়ান মেসেঞ্জার’ নামে একটি প্রভাবশালী মাসিক পত্রিকা বের করতেন। পত্রিকাটিতে তলস্তয়, এবং তুর্গেনেভের লেখা ছাপা হতো।

কাতকোভের টাকা শোধ করতে দস্তয়েভস্কি লেখা শুরু করেন উপন্যাসটি। এর যে নায়ক, রাসকোলনিকোভ, তার চরিত্রটি দস্তয়েভস্কি অনেকটা নির্মাণ করেন, তৎকালীন ফ্রান্সের এক উঠতি কবি ও খুনি, ফ্রাঁসোয়া লাসোনেয়ার আদলে।

মানুষ কোনো অপরাধ করার পর, ভেতরে ভেতরে যে-মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়, তা বর্ণনা করাই ছিলো দস্তয়েভস্কির লক্ষ্য, এবং এটুকোতে তিনি সফল হয়েছেন বলেই মনে করি।

কিন্তু উপন্যাসটিতে, রাসকোলনিকোভের যে-চরিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তাতে রাসকোলনিকোভকে আমার বিচক্ষণ তরুণ বলেই মনে হয়েছে, এবং এরকম একজন বিচক্ষণ তরুণ কেন হুট করে, সামান্য কিছু টাকা চুরি করার লোভে, দুটি খুন করে বসবে— তা আমার বোধগম্য নয়।

তাছাড়া ওই সময়ের রুশ সমাজে, রাসকোলনিকোভের বয়সের ছাত্ররা টাকা চুরির জন্য খুন করতো, এরকম কোনো নজিরও নেই। বিষয়টিকে আমার খুব ফালতু মনে হয়েছে।

লুজিনের সাথে দুনইয়ার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার ব্যাপারটিকেও আমার নাটকীয়তা মনে হয়েছে। একজন অচেনা লোক রাসকোলনিকোভকে দেখে ‘মার্ডারার’ বলে চিৎকার করে উঠেছে, এবং থানায় নিকোলাই নামের এক ভুল লোক, রাসকোলনিকোভের খুনের দায় নিজের কাঁধে নিচ্ছেন, এগুলো খুব খাপছাড়া কাকতালীয়তা মনে হয়েছে।

জে কে রাউলিং বা ড্যান ব্রাউনরা, পাঠক ধরে রাখার জন্য এসব করে থাকেন। এর কারণ সম্ভবত, দস্তয়েভস্কির যে-অভিজ্ঞতা, সে-অভিজ্ঞতা দিয়ে মার্ডারের মতো কোনো ক্রাইমের রিয়েলিস্টিক বর্ণনা দেয়া সম্ভব নয়।

আর আমি তো বলেছিই, দস্তয়েভস্কি উপন্যাসটি লিখেছিলেন স্রেফ টাকার জন্যে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে তিনি একেকবার একেকভাবে উপন্যাসটিকে লিখেছিলেন, এবং পাঠকের কথা ভেবে, বহুবার এর প্লট এবং বর্ণনাভঙ্গী পরিবর্তন করেছিলেন। আমার ধারণা, এ কারণেই নবোকভ তাঁকে মোটামুটি মানের লেখক বলেছিলেন (যদিও নবোকভ ‘দি ডাবল’-এর প্রশংসা করেছিলেন)।

আর আমি জারিস্ট রাশিয়ার যে-ইতিহাস পড়েছি, সেখানে থানা থেকে একজন সন্দেহভাজনের এতো আরামে বাসায় ফেরা অনেকটা অকল্পনীয় ব্যাপার। মেয়েপাগল যে-বুড়োটির চরিত্র আঁকা হয়েছে, সেটিও নানা কাকতালীয়তায় ভরপুর।

তাকে যে-পরিস্থিতিতে দস্তয়েভস্কি আত্মহত্যা করিয়েছেন, সে-পরিস্থিতিতে, আমি মনে করি তার আত্মহত্যা করার কোনো কারণ ছিলো না। এরকম নাটকীয়তা, কেবল শার্লক হোমসওয়ালাদের কাছেই পাওয়া যায়।

দস্তয়েভস্কি তাঁর খ্রিস্ট ধর্মের বিশ্বাসও, আমার মনে হয়েছে রাসকোলনিকোভের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। যেখানেই তিনি যুক্তি খুঁজে পান নি, সেখানেই তিনি রাসকোলনিকোভকে যিশু খ্রিস্টের আশ্রয় নিতে প্ররোচিত করেছেন।

লজিকের চেয়ে মিসটিসিজমকে, দস্তয়েভস্কি প্রায়ই অধিক প্রাধান্য দিতেন। আর পাঠকেরাও, সারা বিশ্বেই এটি আমি দেখেছি, মিসটিসিজম বা রহস্যময়তা খুব পছন্দ করেন।

তবে যারা খুন খারাবি করেন, নানা উদ্দেশ্যে যারা মানুষকে নির্যাতন করতে পছন্দ করেন, তাদের জন্য দস্তয়েভস্কি, এ উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা রেখে গেছেন। মানুষের গায়ে আঘাত করে যে রাতে ঘুমোনো যায় না, এটি ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’-এ খুব স্পষ্ট।

রাসকোলনিকোভকে কিন্তু কোনো পুলিশ গ্রেপ্তার করে নি, এমন কি তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট স্বীকারও করেছিলেন যে— রাসকোলনিকোভকে গ্রেপ্তার করার মতো পর্যাপ্ত প্রমাণ তার হাতে নেই। চাইলেই রাসকোলনিকোভ তার কারাভোগ এড়াতে পারতো।

কিন্তু সে প্রতিদিন তার নিজের বিবেক দ্বারা দংশিত হচ্ছিলো, এবং একদিন বিবেকের তাড়নায়ই সে সবকিছু স্বীকার করেছিলো (যদিও সোনিয়া নামের মেয়েটির কিছু প্রভাব ছিলো বলে মনে হয়েছে)। রাসকোলনিকোভের এ সাইকোলজিক্যাল টেনশন, দস্তয়েভস্কি যেভাবে বর্ণনা করেছেন, তা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। আমার ধারণা, এ বিষয়টির জন্যই আমাদের ব্লুমসবারি গ্রুপের লেখকেরা, বিশেষ করে ভার্জিনিয়া উল্ফ এবং ডি এইচ লরেন্স, ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’-কে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

—মহিউদ্দিন মোহাম্মদ
(বাকি অংশ আগামী পর্বে)