ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন

শুধু গান্ধী কেন, চরিত্রগতভাবে অধিকাংশ ভারতীয় ও দক্ষিণ এশীয় মানুষের কাছে কালো মাত্রই ব্রাত্য। অধিকারভোগী শ্রেণির মানুষ হিসেবে গান্ধী তাঁর সমগোত্রীয়দের মতো কালোদের প্রতি বিদ্রূপাত্মক মনোভাব পোষণ করবেন, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

শৈশব থেকেই তো আমাদের সবার কালো গাত্রবর্ণের প্রতি বিরূপ মনোভাব। গায়ের রং সাদা করার জন্য আমাদের দেশের মানুষদের কী প্রাণান্ত চেষ্টা। শুধু মেয়েদের জন্য নয়, ছেলেদের জন্যও তাই ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী’র ব্যবস্থা হয়েছে।

কালোদের প্রতি আমাদের প্রচ্ছন্ন অবজ্ঞা বা ঘৃণার উৎস সমাজের শ্রেণিগত বিভক্তি। কালো মানে ময়লা। অর্থাৎ অশুচি। কালো মেয়ের দুঃখ নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে কবিতা লিখতে হয়েছে।

সেই রবীন্দ্রনাথকে আমরা সর্বদা গৌরবর্ণের বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসি, যদিও প্রকৃত গৌরবর্ণের মানুষের চোখে তিনি কালোই ছিলেন।

শুধু আমাদের নয়, আমেরিকার কালোদের মধ্যেও সুন্দর মানে ভাবা হতো সাদা। এখনো আমেরিকায় কালো শিশুরা সাদা ও সোনালি চুলের বারবি ডল নিয়ে খেলতে ভালোবাসে।

ব্ল্যাক ইজ বিউটিফুল স্লোগান তো এই সেদিনের।

স্বদেশে হোক বা প্রবাসে, বর্ণগতভাবে আমরা উপমহাদেশের সবাই কালো মানুষ, অথচ কেউ নিজেদের কালো ভাবতে প্রস্তুত নই। আফ্রিকান-আমেরিকানদের আমরা নিগার বলি না ঠিকই, কিন্তু বলি ‘কালুয়া’। সেটা কদর্থেই বলা। কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামে দক্ষিণ 
আফ্রিকা থেকে আসা কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারদের দর্শকদের বর্ণবাদী বিদ্রূপের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

কালোর প্রতি এ ঘৃণা আমাদের রক্তে।
কালো হয়তো গায়ের রং, কিন্তু কালো বলতে আসলে আমরা বোঝাই দরিদ্রকে। নিজেরা দরিদ্র হলেও দরিদ্রের প্রতি অনেক সময়েই আমাদের সহানুভূতি নেই।

প্রবাসে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে, আমরা বাঙালিরা দৈনন্দিন বৈষম্যের সম্মুখীন হলেও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ নেই। এর পেছনে শৈশব থেকে গড়ে ওঠে কালোবিদ্বেষ একটি কারণ। অন্য কারণ বিদেশে সফল হতে হবে, এ মনোভাব নিয়ে আমরা সব বিদ্রূপ সয়ে চলি, মুখ কামড়ে পড়ে থাকি।

অধিকাংশ ব্যাপারেই আমরা শ্বেতাঙ্গদের পক্ষে, সে জন্য এ দেশে আমাদের ‘মডেল মাইনরিটি’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

ক্ষমতাসীন শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে, সম্ভবত এ ভয় থেকেই এ দেশে নাগরিক অধিকারের পক্ষে যে আন্দোলন, তার কোনোটাতেই আমরা নেই।

বর্তমানে আমেরিকাজুড়ে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন চলছে, তাতে সবাই আছে, দক্ষিণ এশীয়রা কেন নেই, এমন প্রশ্ন তুলেছে সিএনএন।

সাদাদের নীরবতা যদি সহিংসতার সমার্থক হয়, তাহলে দক্ষিণ এশীয়দের নীরবতাও কার্যত বর্ণবাদের সমর্থনে সহিংসতা, এমন কথাও বলা হচ্ছে।

আশার কথা, এ অবস্থা বদলানো শুরু করেছে। নবীন প্রজন্মের সদস্যরা খোলামেলাভাবেই ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করেছে।

তারা এখন নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে পিওসি বা পিপল অব কালার এই নামে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, কানাডা ও যুক্তরাজ্যেও দেখছি কালো ও বাদামি মানুষদের হাতে হাত ধরে চলা। সংখ্যায় হয়তো কম, কিন্তু তারাও ক্রমে পথে নামছে।

এ আন্দোলনের ভেতর দিয়েই প্রবাসে হয়তো কালোর প্রতি আমাদের মনোভাব বদলাবে, কিন্তু উপমহাদেশে আমাদের মনের ভেতর যে বর্ণবাদ আসন গেড়ে বসে আছে, তা বদলাবে কীভাবে?