বিসিএস হতাশা এবং সমাজের চাপ

এক যুগ আগেও বিসিএস নিয়ে এমন মাতামাতি ছিল না। ক্লাসের পড়া বাদ দিয়ে বিসিএস পড়ার এমন সর্বজনীন চলও ছিল না।

অভিভাবক সমাজ চাকরির সম্মান আর নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে সন্তানদের বিসিএস বা অন্য সরকারি চাকরির পরামর্শ দিলেও কেউ শুনত, কেউ শুনত না। করপোরেট অথবা বহুজাতিক কোম্পানির চাকচিক্য আর বেশি বেতনের চাকরি মধু হয়ে ভ্রমরদের আহ্বান করত।

এরপরই ঘটে গেল দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

প্রথমত, সরকার প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিকে মাথায় রেখে তার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে দিল। সরকারি চাকরির এন্ট্রি লেভেল বেতন প্রায় বেসরকারি চাকরির এন্ট্রি লেভেল বেতনের সমান বা বেশি হয়ে গেল, বোনাস হিসেবে পাওয়া গেল চাকরির নিরাপত্তা।

Government job security

দ্বিতীয়ত, কোনো একটি বিসিএসে প্রথম হওয়া একজন অফিসার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে ঘুরে ক্যারিয়ার আড্ডা আয়োজন করে অনেক দিশাহীন চাকরিপ্রার্থীদের নাবিক হয়ে হাল ধরলেন এবং তাঁদের মোটিভেশন দিয়ে নিজ ব্যক্তিত্বগুণে ব্যাপক প্রচারিত হয়ে সেলিব্রিটির মর্যাদা পেলেন।

Celebrity. Pinclippart

সেই সঙ্গে কোনো একজন তরুণ পুলিশ সদস্য হয়তো তাঁর জনমুখী কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যাপক প্রশংসিত হলেন এবং সামাজিক  যোগাযোগমাধ্যমে সরব উপস্থিতির জানান দিয়ে ‘পাশের বাসার পুলিশ’ হিসেবে খ্যাত হলেন।

তরুণেরা বুঝে গেল সরকারি চাকরি করে সেলিব্রিটির মতো জনপ্রিয়তাও তাহলে অর্জন করা যায়। এই দুইয়ে মিলে সরকারি চাকরির মধ্যে বিশেষত বিসিএসের চাকরি আর চাকরি থাকল না, একটি কাল্টে পরিণত হলো।

বিসিএস চাকরির জন্য চাকরিপ্রার্থীদের আবেদনসংখ্যা বিভিন্ন ছোট দেশের জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে যেতে লাগলে। তবলার ঠোকাঠুকি অনেক হলো, এবার মূল সংগীতে আসা যাক।

এই আলোচনা সফলদের নিয়ে না। যাঁরা বিসিএসে সাফল্য পেয়েছেন তাঁদের প্রতি সম্মান জানাচ্ছি। যাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন বা হচ্ছেন, তাঁদের নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।

বর্তমান বিসিএস চাকরি-সাধনার আসলে দুটো রূপ আছে। যাঁরা প্রায় ৩ বছরের ধৈর্য-সহ্যের পরে চাকরি পেলেন, তা×রা ইন্দ্রজাল বিস্তার করে সমাজে প্রবল হয়ে গেলেন। যাঁরা পেলেন না, তাঁরা নৈরাশ্যের অন্ধকারে ডুবে পরবর্তী লাইটহাউসের সন্ধান করতে লাগলেন। স্নাতক পর্যায়ের পড়ালেখা শেষ করতে বাংলাদেশে গড়ে বয়স হয়ে যায় ২৩ বছরের মতো।

একেকটি বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল আসতে মোটামুটি আড়াই থেকে তিন বছর লাগে। ২৩ থেকে ৩০—তারুণ্যের এই শ্রেষ্ঠ সময়ের বিনিয়োগ হয় এমনই এক ঝুঁকিপূর্ণ এক সম্পদপ্রাপ্তির প্রতিযোগিতায়, যে সম্পদ লুকিয়ে আছে যেন এক পিরামিডের চূড়ায়।

খুব অল্পসংখ্যক মানুষ সেই চূড়ায় উঠতে পারবে, বাকিরা পিরামিডের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়বে। কেউ আবার ঘুরে দাঁড়াবে, কেউবা হারাবে কালের অতলে। কিন্তু এই মানুষগুলো কি মেধাবী ছিল না? অবশ্যই মেধাবী ছিল।

He also read and wrote

কিন্তু সেই মেধার চূড়ান্ত প্রকাশ হয়তো ঘটতে পারত অন্য কোনো ক্ষেত্রে। তাঁরা হতে পারতেন প্রজ্ঞাবান শিক্ষক, সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তা, শাণিত বিজ্ঞানী, বিচক্ষণ দার্শনিক, ঝলমলে ব্যাংকার, অথবা করপোরেট কিং। তাহলে তাঁদের কে আটকে দিল? এর উত্তর আসবে বেশ কয়েকটি ধাপে।

বিসিএস একটি পুণ্যধাম হিসেবে আবির্ভূত হলেও সবাই যে সানন্দে সেদিকে পদযাত্রা করেছেন, তা নয়। একটি বড় অংশ বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে থাকেন অভিভাবকদের চাপে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিভাবকেরা আসলে অনুভব করেন সমাজের চাপ।

Ultimate this pressure press on me

এ কথা অনস্বীকার্য যে সমাজ একজন লাখ টাকা উপার্জনকারী উদ্যোক্তাকে যে চোখে দেখে, একজন সরকারি চাকুরেকে দেখে তার চেয়ে সম্মানের দৃষ্টিতে।

সমাজ একজন বেসরকারি চাকরিজীবী বা উদ্যোক্তার চেয়ে একজন সরকারি চাকরিজীবীর কাছে কন্যাদান করতে বেশি নিরাপদ বোধ করে। উচ্চপদে সরকারি চাকরিজীবী আত্মীয়ের জন্মদিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘটা করে শুভেচ্ছা জানানো হয়, অন্য চাকরি করা আত্মীয়ের বেলায় হয়তো ফোন করে খোঁজ নেওয়াটাও হয়ে ওঠে না।

অনেকে আবার নিজের বন্ধুতালিকায় উচ্চপদের সরকারি চাকরিজীবীদের রাখতে পেরে সামাজিক নিরাপত্তা লাভের অনুভূতি পেয়ে যান। এর পেছনে মূল কারণ হলো, প্রায় ২০ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে সরকারের আন্তরিক চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ধরনের সেবা পেতে লবিং বা ক্ষমতা প্রদর্শনের চল রয়েছে।

নিজের বন্ধু অথবা নিকটাত্মীয় যদি ক্ষমতাশালী হন, সামাজিক নিরাপত্তার একটি অতিরিক্ত পরত গায়ে জড়ানো যায় এবং পরিচিতজনের গণ্ডিতে সম্ভ্রম পাওয়া যায়।

It feels also them secure and prestigious.

সমাজ নানাভাবে অভিভাবকদের সেই কথা মনে করিয়ে দিতে থাকে। তাই সমাজের চাপে ভালো চাকরি ছেড়ে অথবা ভালো চাকরির হাতছানি এড়িয়ে সম্ভাবনাময় অনেক তরুণ বিসিএস দেন, দিতেই থাকেন। দুঃখের ব্যাপার হলো, তাঁরা যখন ব্যর্থ হন তখন কি সমাজ এসে তাঁকে কোনো সান্ত্বনার বাণী কখনো শুনিয়েছে?

আর্থিক অনটনের সময় কি সমাজ এসে একমুঠো চাল দিয়েও সাহায্য করেছে? এর উত্তর সবার জানা।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থাও এই বিসিএসগামী জনস্রোতের দায় এড়াতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজগুলোতে যে বিষয়সমূহ পড়ানো হয়, তার অনেক বিষয়ের ব্যবহারিক প্রয়োগ করার মতো কাজের সুযোগ এই দেশে যথেষ্ট পরিমাণে নেই।

নিজের অধীত বিষয়ে ভালো ফলাফল চাকরির নিশ্চয়তা অনেকাংশেই দেয় না। দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করা বা স্থায়ী হওয়ার সুযোগ বা মানসিকতা সবার থাকে না।

তাই শিক্ষার্থীদের আশা–ভরসার কমন প্ল্যাটফর্ম হয়ে যায় বিসিএস। আজকাল অনেক চিকিৎসক আর প্রকৌশলীও নিজেদের পেশা বদলে ফেলে পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশে চলে যাচ্ছে।

Migration to BCS

দেশের মোট চিকিৎসক বা প্রকৌশলীর সংখ্যার তুলনায় এই পেশা বদলে ফেলা চিকিৎসক বা প্রকৌশলীর সংখ্যা নগণ্য হলেও এর কারণ অনুসন্ধান অত্যন্ত গুরুত্বের দাবি রাখে।

একজন ডাকসাইটে পররাষ্ট্র, প্রশাসন বা পুলিশ কর্মকর্তার সামাজিক জৌলুশ, সামাজিক নিরাপত্তা এবং নবলব্ধ ভক্ত-অনুগামীদের প্রাবল্যের সামনে কি তাহলে সেই চিকিৎসক বা

প্রকৌশলীরা বিপন্ন বোধ করতে শুরু করেছেন? অনেকেই দেশসেবার বুলি আওড়াতে পছন্দ করেন। দেশ বা মানুষের সরাসরি সেবা তো চিকিৎসক আর প্রকৌশলীরা করতেই পারেন। কেউ কেউ আবার বলেন ব্যক্তিগত পছন্দের কথা।

যে দক্ষতা অর্জনে জীবনের এতগুলো বছর পার করে ফেললেন তাঁরা, সেই দক্ষতা অর্জন যদি তাঁদের ব্যক্তিগত অপছন্দে হয়ে থাকে তবে ভিন্ন কথা, কিন্তু শুধু জৌলুশ-নিরাপত্তা-ভক্তি লাভ যদি হয় উদ্দেশ্য, তবে তা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য হতাশাজনক।

এই দেশে একজন গবেষকের গবেষণা নিয়ে মাতামাতি হয় না। একজন মেধাবী তরুণ উদ্যোক্তা কোনো ব্যবসা দাঁড় করালে ফেসবুকে তাঁর নামে পোস্টের ছড়াছড়ি হয় না।

একজন প্রাইভেট ব্যাংকার ছয় ধাপের পরীক্ষা দিয়ে নিজ যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে চাকরি পেলেও তিনি সমাজ এবং পরিবারের চোখে প্রতিষ্ঠিত হন না।

বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তার নিজের টাকায় কেনা ঝা-চকচকে বিএমডব্লিউ গাড়িও একজন বিসিএস ক্যাডারের সরকারি গাড়ির কাছে পানসে হয়ে যায়।

এমনকি শিক্ষা ক্যাডার পেয়েও আবার পররাষ্ট্র-পুলিশ-প্রশাসনের আশায় অনেকে বিসিএস দিতেই থাকেন।

এমন সমাজব্যবস্থায় বিসিএস না দিয়ে উপায় কী? এসব লেখা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে।

ইদানীং শুনতে পাচ্ছি যে স্কুলজীবন থেকেই নাকি শুরু করা দরকার বিসিএসের প্রস্তুতি। বড়ই সর্বনাশের কথা

Nothing to say!

সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারা দেশের খাঁটি সেবকদের মধ্যে অগ্রগামী। এই করোনাযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি আক্রান্তদের মধ্যে চিকিৎসকের পরের অবস্থানেই আছেন প্রশাসন আর পুলিশের সাহসী কর্মকর্তারা। সিভিল সার্ভিস অবশ্যই মহান এবং সম্মানের পেশা।

কিন্তু এটিই একমাত্র সম্মানজনক চাকরি নয়। তথাকথিত ভক্ত-মোসাহেবরা তাঁদের নিজ নিজ সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির স্বার্থে অধিক প্রচারণার মাধ্যমে সিভিল সার্ভিসের চাকরি করা মানুষকে প্রভুর আসনে আসীন করেন।

সিভিল সার্ভেন্টরা জনগণের সেবাদাতা, প্রভু নন। মনে রাখতে হবে প্রভু কখনো ‘চাকরি’ করেন না। প্রয়োজন ফুরালে, অবসরে গেলে, অথবা প্রভাবশালী চেয়ার হারালে এই নব্য মোসাহেবদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাঁরা ভিড় করবেন অন্য কারও আশপাশে।

দেশের তরুণদের বিরাট অংশ বিসিএসে চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভোগেন। এই হতাশা তাঁদের জীবনীশক্তি এবং আত্মবিশ্বাস শুষে নেয়।

নিজের সামর্থ্য বিবেচনা না করে বিসিএসের জন্য যৌবনের সেরা সময় উৎসর্গ করা উচিত নয়। হাতে বিকল্প ঠিক করে রাখা প্রয়োজন। কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন এবং এর ব্যাপক প্রসারের প্রতি নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ দেওয়া দরকার।

সরকারি চাকরিগুলোর মধ্যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সর্বোচ্চ সম্মানের এই বিসিএস চাকরি ছাড়াও অন্য চাকরি করে যে ভালোভাবে বেঁচে থাকা যায়, তা অভিভাবকদেরও অনুধাবন করতে হবে।

Think and judge

অন্যের সন্তানের সঙ্গে নিজের সন্তানের তুলনা করা বন্ধ করতে হবে। অভিভাবকদের বুঝতে হবে যে প্রতিটি মানুষই স্বতন্ত্র। তাদের মানসিক গঠন, চিন্তাধারা, গুণাবলি সবই স্বতন্ত্র। সমাজকে তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। না পাল্টালেও ক্ষতি নেই। তথাকথিত সমাজের চাওয়া দিয়ে কিছু যায় আসে না।

নিজের সন্তানের সাফল্য দেখা যত আনন্দের, তাকে হতাশ হতে দেখা আরও কষ্টের। নিজের পিঠে পিতা–মাতার ভালোবাসামাখা ভরসার হাতটা এই ছেলেমেয়েগুলোর এ মুহূর্তে খুব বেশি দরকার।

আলোচনা ও বিশ্লেষন:-  আসিফ ইমতিয়াজ

শিক্ষক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সোর্স