আয়া সোফিয়াকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তরের তর্ক-বিতর্কের বিশ্লেষন

নট অ্যান এরদোয়ান ফ্যান। বাট আয়া সোফিয়া নিয়ে যেভাবে সমালোচনা হচ্ছে, তার কোনো যুক্তি দেখছি না।

সমালোচনার ম্যাক্সিমাম গ্রাউন্ড হতে পারত এরকম – কোর্টের অনুমতি পাওয়ার পরেও আয়া সোফিয়াকে মসজিদ না বানালে সেটা আরো বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত হতে পারত। কিন্তু সেটা তুরস্কের নিজস্ব হিসাবনিকাশের ব্যাপার। তারা যথেষ্ট উদারতা দেখায়নি – বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এটা খুব বেশি সমালোচনার কিছু না।

আয়া সোফিয়ার সাথে বাবরি মসজিদের বা আল-আকসার বা স্পেনের মসজিদগুলোরও তুলনা চলে না। সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপট। আয়া সোফিয়া যখন মসজিদ হয়েছিল, শতশত বছর আগে, তখন সেটাই বিশ্বের বাস্তবতা ছিল। সেটাকে যদি বর্তমানের প্রেক্ষাপটে অন্যায়ও ধরা হয়, তবুও বর্তমানে সেই অন্যায় শোধরানোর দায়িত্ব কারো উপর বর্তাবে না।

ঐহিতাসিক ভুল শোধরাতে গেলে পুরো দুনিয়ে ওলটপালট করে দিতে হবে। ওটা বাস্তবসম্মত না।

দেখতে হবে বর্তমানের যে রাষ্ট্রীয় কাঠামো, সেটা প্রতিষ্ঠার সময় আয়া সোফিয়ার অবস্থান কী ছিল। এবং দেখা যাচ্ছে সেটা মসজিদই ছিল। এর আগের কয়েকশো বছর ধরেই। এরপর কামাল আতাতুর্ক তার অতিরিক্ত উদারতার কারণে (পড়ুন ইসলাফোবিয়ার কারণে) সেটাকে মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করেছে।

এখন সেই মিউজিয়ামকে মসজিদে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। এবং যেহেতু কোর্ট আতাতুর্কের সময়ের সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে, তাই এটার আইনগত বৈধতাও আছে। এখন তুরস্কের আদালত নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। প্রচুর রিপোর্ট আছে এরদোয়ানের সরকার কীভাবে বিচারব্যবস্থার উপর হস্তক্ষেপ করছে, অপছন্দের বিচারকদেরকে গ্রেপ্তার করছে, সরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ওটা জেনারেলাইজড সমালোচনা।

এই স্পেসিফিক কেসের ক্ষেত্রে সেরকম কোনো অভিযোগ উঠেছে কিনা, সেটা না জেনে ঐ অভিযোগ এখানে তোলার মানে নেই।
রূপান্তর প্রক্রিয়াটাকে তাই আইনগতভাবে বৈধই বলতে হবে। এবং আন্তর্জাতিক রিঅ্যাকশনও যদি লক্ষ্য করেন, অনেক দেশ বা খ্রিস্টান কর্তৃপক্ষ হতাশা এবং দুঃখ প্রকাশ করেছে, কিন্তু কঠোর নিন্দা জানানোর মতো ঘটনা কি ঘটেছে? আমার চোখে পড়েনি।

এখানে লক্ষণীয়, বাবরি মসজিদের মতো এখানে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদেরকে উৎখাত করে, তাদের উপাসনালয় ধ্বংস করা হচ্ছে না। আকসার মতো জাতিসংঘের রেজোল্যুশন অমান্য করে এলাকা এবং সেখানে থাকা উপাসনালয় দখল করে নেওয়া হচ্ছে না।

মানুষ এই তুলনাগুলো কীভাবে দিচ্ছে কে জানে!
সুতরাং আমার দৃষ্টিতে আয়া সোফিয়াকে মসজিদ করায় এমন কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়নি। প্রশ্নটা হবে, বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে এটা না করলে কি আরো ভালো হতো? এটা একেকজন একেকভাবে ব্যাখ্যা করবে।

আমি স্পেসিফিকভাবে এই ঘটনার কথা না বলে একটু ব্রড উদাহরণ টানি। ধরুন বাংলাদেশে যে আয়মান সাদিকদেরকে নিয়ে অনলাইনে তুমুল সমালোচনার ঝড় বয়ে গেল, সেই সমালোচনার অধিকার কি মানুষের ছিল না? অবশ্যই ছিল। ধর্মের কথা বাদ দিতে চাইলেও শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও মানুষের সোচ্চার হওয়ার অধিকার আছে।

কিন্তু প্রথম কয়েকদিনের পরে যেভাবে সমালোচনাটা গালাগালির পর্যায়ে গেছে, এবং এরপর যেভাবে টেন মিনিটস থেকে ইসলামিক বিষয়ে ভিডিও বানানোর প্রস্তাবনা এসেছে, তাতে ফলাফলটা কী হয়েছে?

আগে থেকে ডিটারমাইন্ড মানুষের কথা আলোচনার বাইরে রাখেন। মাঝামাঝি যেসব বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ থাকে, তাদের কথা ভাবেন। তাদের একটা অংশের মনে কী এই ঘটনার পরে এরকম ভাবনার উদয় হয়নি যে, “বাবারে বাবা, ক্ষমতায় নাই, দৌড়ের উপর আছে, তারপরেও এই মোল্লা শ্রেণী/ইসলামপন্থীরা/ধর্মান্ধরা এতো বাড়াবাড়ি করছে, ক্ষমতায় না গেলে জানি কী করবে?”
এই ভাবনাটা ডেঞ্জারাস। এর ফলাফল আমরা বিভিন্ন দেশে দেখতে পাই।

লিবিয়ার নির্বাচনে যে মুসলিম ব্রাদারহুডের ভরাডুবি হয়েছিল, তার প্রধান কারণ মানুষের এই মনোভাব – এরা ক্ষমতায় আসলে কী জানি করে ফেলবে! মিসরে মুরসির পতনের পেছনেও এই মনোভাবের ভূমিকা আছে।

অফকোর্স মুরসির পতনের পেছনে মূল দায় মিসরের ডীপ স্টেটের, সৌদি-ইমারাত-ইসরায়েলের।

কিন্তু এরকম অভ্যুত্থানের চেষ্টা তো অনেক দেশেই হয়, সব দেশে তো এত তাড়াতাড়ি সফল হয় না। মিসরে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ মুরসির বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এসে এই অভ্যুত্থানের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল, তাদেরকে রাস্তায় নামার সুযোগ করে দিয়েছে সেনাবাহিনী, কিন্তু তাদের মধ্যে যদি এই মনোভাব না থাকত, তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত।

তুরস্কের এই ঘটনাকে আমি এর সাথে মিলিয়ে দেখি। আয়া সোফিয়াকে মসজিদ বানানোয় সরাসরি কারো কোনো ক্ষতি হবে। বিদেশীরা বা খ্রিস্টানরা তুরস্কের বিরুদ্ধে কিছুই করবে না, অন্তত এই মুহূর্তেই না। কিন্তু একে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যেই পক্ষে-বিপক্ষে যেভাবে আলোচনা হচ্ছে, সেটা মঙ্গলজনক না।

সমালোচকদের অযৌক্তিক সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে অধিকাংশ সমর্থকই যেভাবে উত্তর দিচ্ছে, তাতে যারা কমেন্ট করছে না, নীরব দর্শক হিসেবে উপভোগ করছে, তাদের একটা বড় অংশের মনে এই আশঙ্কা জাগ্রত হওয়া স্বাভাবিক – এই সমর্থকদের দল ক্ষমতায় গেলে এরা ভিন্নমতের কোনো অধিকার বরদাশত করবে না।

এরা নিজেরা নির্যাতিত হলে ঠিকই পশ্চিমা মডেলের গণতন্ত্রের কথা বলে, নাগরিক অধিকারের কথা বলে চিৎকার করে, কিন্তু নিজেদের হাতে একটু পাওয়ার এলেই সব ভুলে গিয়ে আর্লি ইসলামিক রেফারেন্সে চলে যায়।

বর্তমানে দেশে দেশে যারা ক্ষমতায় আছে, তারা যে খুব সৎ এমন না। তাদেরও প্রচুর ভণ্ডামি আছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে স্ট্যাটাস কো মেইন্টেইন করে চলার একটা প্রবণতা থাকে। সুতরাং আগামী দিনগুলোতে যারা সেরকম অর্থে আর্লি ইসলামিক রুলসে ফিরে যেতে আগ্রহ বোধ করে না (অর্থাৎ সমাজের অধিকাংশ মানুষ), তাদের বাকিদের প্রতি ভীতি বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

অবশ্য সম্পূর্ণ বিপরীতটাও ঘটতে পারে। দেশে দেশে হিন্দু, খ্রিস্টান পপুলিস্ট লিডাররা বেশ ভালো অবস্থানে আছে। হয়তো একাধিক দেশে মুসলিম পপুলিস্ট লিডারেরও উত্থান ঘটতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে সেটাও ভালো হবে কিনা, সেটা আরো জটিল আলোচনা।

 

© Mozammel Hossain Toha