সব ইহুদীই কি ইজরায়েলের সমর্থক?

শিক্ষা-দীক্ষা বাদ দিয়ে মুসলমান সম্প্রদায় যখন ফিলিস্তিন ইস্যুতে আলে সৌদদের ছাড়ানো ‘ইহুদী-নাসারা’ বয়ানে পাইকারী হারে বিশ্বাস করে, তখন বিশ্বব্যাপী তাদের মারা খাওয়া ঠেকায় এমন সাধ্য কার?

অর্থডক্স ও আরব বংশোদ্ভূত ইহুদী এবং আরব খ্রিস্টানরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই ফিলিস্তিনের পক্ষে। ফিলিস্তিনকে ওসমানিয়া খেলাফতের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়েছিল বর্তমান সৌদি বাদশার বাবা আব্দুল আজিজ।

ফিলিস্তিন দখলের শেষ যুদ্ধ হয়েছিল বর্তমান গাজায় এবং সেই যুদ্ধে ইংরেজ ও সৌদ বাহিনীর বিরুদ্ধে ওসমানিয়া বাহিনীর পক্ষে ফিলিস্তিনের ইহুদী এবং দ্রুজ খ্রিস্টানরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল, পরাজিত হয়েছিল। বৃটিশরা ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষনার বাস্তবায়ন করতে শুরু করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে জায়নবাদী ইহুদীদের প্যালেস্টাইনে পুনর্বাসনের মাধ্যমে।

আরব ফিলিস্তিনে বাইরে থেকে আনা হিব্রুভাষী ইহুদীদের পুনর্বাসনের বিরুদ্ধে ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত বিখ্যাত আরব বিদ্রোহ চলেছে; যাতে সামিল হয়েছে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের পাশাপাশি অনেক আরব ইহুদী এবং খ্রিস্টান।

১৯৩৬ সালের ১৮ জুন আরব খ্রিষ্টানদের মালিকানাধীন ফালাস্তান পত্রিকায় একটি কার্টুনসহ ছাপা হয়- ‘জায়নবাদীরা ফিলিস্তিনকে কুমিরের মত গিলে খাবে’।

১৯৩৬ সালের ১৮ জুন আরব খ্রিষ্টানদের মালিকানাধীন ফালাস্তান পত্রিকায় একটি কার্টুনসহ ছাপা হয়- ‘জায়নবাদীরা ফিলিস্তিনকে কুমিরের মত গিলে খাবে’।

এখানে জায়নবাদ কী সেই জিনিসটা আগে বোঝা প্রয়োজন। ইহুদী ধর্মের সাথে জায়নবাদের কোন সম্পর্ক নেই। ‘জায়নবাদ’ হচ্ছে সমগ্র বিশ্বের ইহুদীদের জন্য প্যালেস্টাইনকে কেন্দ্র করে একটি ইহুদী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ধারণা।

ইহুদী নয় এমন অনেক খ্রিস্টান, হিন্দু এবং মুসলমানও জায়নবাদী। আবার আরব ইহুদীসহ অর্থডক্স ইহুদীদের বিশাল একটা অংশ মনে করে ‘জায়নবাদ’ হচ্ছে ‘বর্ণবাদ’। ফলে তারা ইজরাইলের বিরোধী; তারা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চায়।

ভুলে যাবেন না, ইউরোপ থেকে আসা হিব্রুভাষী ইহুদীদের জায়গা করে দিতে গিয়ে আরবী ভাষী অনেক মুসলমান ফিলিস্তিনির মত অনেক খ্রিস্টান ও ইহুদী ফিলিস্তিনিদেরও জায়গা-জমি হারাতে হয়েছে। ওখানে বিভেদটা মূলত আরবীভাষী ফিলিস্তিনী (মুসলমান+ইহুদী+খ্রিস্টান) বনাম হিব্রুভাষী জায়নবাদী।

বর্তমান পৃথিবীতে মুসলমানদের এবং ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার Noam Chomsky , Bernie Sanders এবং Dr Norman Finkelstein জন্মগতভাবে ইহুদী। আবার ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সবচেয়ে বেশি কার্টুন আঁকা ব্রাজিলের কার্লোস লাতুফ এবং স্পোর্টস কমেন্টেটর মিয়া খলিফা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। সমগ্র পশ্চিমা মিডিয়া যখন ইজরাইলের পক্ষে, তখন এই মানুষগুলো তাদের বিশাল সামাজিক গণমাধ্যম সমর্থকদের উদ্দশ্যে একের পর এক ফিলিস্তিনের পক্ষে ও ইজরাইলের বিরুদ্ধে লিখে যাচ্ছেন।

নরমান ফিংকেলস্টেইন তো রাস্তায় প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেফতারও হয়েছিলেন। পুরো প্যারার সারর্মম হচ্ছে- এই মানুষগুলো ইহুদী-নাসারা হলেও ফিলিস্তিনের পক্ষে, মুসলমানদের পক্ষে। খোদ মুসলমানরা যখন হামাসকে সমর্থন করে লিখতে সাহস পায় না, তখন মিয়া খলিফা তার টুইটার থেকে হামাসের পক্ষ নিয়ে ইজরাইলিদের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ করে যাচ্ছে।

এবার আসেন দেখি, ইউরোপ থেকে আসা হিব্রুভাষী ইহুদী এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে থাকা জায়নবাদী ইহুদী, হিন্দু ও খ্রিস্টানদের পাশাপাশি মুসলমানদের মধ্যে কারা জায়নবাদী? কারা ইজরায়েল এর এই নির্মম হত্যাযজ্ঞকে পরোক্ষভাবে সমর্থন দিচ্ছে?

সৌদি আরবে মক্কার মসজিদুল হারাম এবং মদিনার মসজিদুন নবী’র ঠিক পাশেই দু’টো হিলটন হোটেল আছে। হিলটন পরিবার হচ্ছে একটি জায়নবাদী পরিবার এবং এই দুই হোটেলসহ বিশ্বের যেখানে হিলটনদের যত ব্যবসা আছে তার একটা অংশ যায় জায়নবাদী রাষ্ট্র ইজরাইলে, যে টাকায় গুলি কেনা হয় এবং সেই গুলিতে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হয়।

যারা মিয়া খলিফার তিন মাসের এডাল্ট ফিল্ম ক্যারিয়ার নিয়ে বেশি উত্তেজিত, তারা একটু Paris Hilton সম্পর্কে খোঁজ খবর করতে পারেন। এবার বলেন তো জায়নবাদীদের পৃষ্ঠপোষকদের মক্কা-মদিনায় আল্লাহর ঘর এবং রাসুল (স:) এর রওজার পাশে হোটেল বানাতে দিলো কারা?

ইজরায়েলের সবচেয়ে মুসলমান বিদ্বেষী ক্লাবের নাম ‘বাইতার জেরুজালেম এফসি’। প্রতিটা ম্যাচের সময় তাদের ক্লাব সমর্থকেরা আরব এবং মুসলমানদের ধ্বংস কামনা করে স্লোগান দেয়। তার ম্যাচ চলাকালে রসুল (সা:) কে অসম্মান করে। খেলার চেয়ে ধর্মীয় উগ্রবাদকে বেশি প্রাধান্য দেয়ায় এই ক্লাব দেউলিয়া হবার অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল। ক্লাবটিকে বাঁচিয়েছে কে জানেন? ২০২০ সালে আরব আমিরাতের রাজ পরিবারের শেখ হামাদ বিন খলিফা আল নাহিয়ান ৯০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে এই ক্লাবের ৫০% মালিকানা কিনে নেন। তারপর থেকে তথাকথিত মুসলমানের টাকায় পরিচালিত এই ক্লাবের সদস্য, সমর্থক ও সামাজিক মাধ্যমের আইডি দিয়ে ফিলিস্তিনি এবং মুসলমানদের গালাগালি করে যাচ্ছে!

আপনাদের হয়তো জানা নেই, খোদ ইসরাইলে অনেক মুসলমান আছে যারা জায়নবাদী। ইসরাইলী সেনাবাহিতে চাকরি করে এবং ফিলিস্তিনিদের উপর গুলি চালায় এমন মুসলমানও আছে।

কাজেই ফিলিস্তিন ইস্যুতে সকল ‘ইহুদী-নাসারা’দের গালি না দিয়ে পক্ষে থাকা ইহুদী-নাসারাদেরও চিনতে চেষ্টা করুন। পাশাপাশি ইজরাইলের পক্ষ নেয়া তথাকথিত মুসলমানদেরও চিনতে চেষ্টা করুন।

– এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান