‘মেটা’ মানে কী?

ফেসবুকের প্যারেন্ট কোম্পানির নাম ‘মেটা’ ঘোষণা দেয়ার পর আমি দুটো ট্রল খেয়াল করেছি। এক হলো বাংলায় কিছু ট্রল, যে কীভাবে ‘ছেলেটা’ না হয়ে ‘মেয়েটা’ নাম রেখেছে ফেসবুক। আর দ্বিতীয় ট্রলটি হলো কীভাবে হিব্রুতে ‘মেটা’ মানে ‘মৃত’, দুটোই একই জাতের ট্রল, যা পাত্তা দেয়ার মতো কিছু না। ট্রলের বিষয়টি অপ্রয়োজনীয়, কিন্তু কখনও কখনও প্রয়োজনীয়, কারণ আমরা আগেও দেখেছি কোনো ব্র্যান্ডের নাম বিভিন্ন দেশে ভয়াবহ অনুবাদ হয়ে দাঁড়ায়। ভাষাগত ব্যারিয়ারের কারণে ছোটখাটো অনেককিছুই আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।

তবে ফেসবুকের ‘মেটা’-র ট্রলের ব্যাপারে যদি বলি, সকল হিব্রুভাষী যেমন জানে যে এটা স্রেফ ট্রল, তেমন বাংলাভাষীরাও জানে ফেসবুকের আসলে তেমন ঠেকা পড়েনি ল্যাংগুয়েজ ফোকাস গ্রুপ হিসেব করে ‘কাছাকাছি’ উচ্চারণের বাংলা শব্দ ‘মেয়েটা’-কে আমলে আনবে। তবে একটু অবাক হলাম যখন সেই ট্রলগুলোকে টুইট থেকে ধরে এনে নিউজ হিসেবে প্রচার করেছে অনেকগুলো মিডিয়াই। তবে মূল খবরগুলোতে এটা অবশ্য উল্লেখ আছে, যে, উচ্চারণটা ‘কাছাকাছি’, একই নয়।

এই পার্থক্যটা নামের বানান দেখে ইংরেজিভাষীদের বোঝার উপায় নেই। কিন্তু বাংলাভাষীরা ঠিকই বুঝবেন!

হিব্রু ‘মেৎ’ (מֵת) অর্থ ‘মৃত’। ইংরেজিতে লেখার একমাত্র উপায় ‘met’, যা কেবল ইংরেজি জানা ব্যক্তিরা পড়বেন মেট। ‘মেতা’ (מֵתה) অর্থ ‘মৃতা’। ইংরেজিতে লেখার একমাত্র উপায় ‘meta’, যা কেবল ইংরেজি জানা ব্যক্তিরা পড়বেন মেটা।

হিব্রু আর আরবি সিস্টার ল্যাংগুয়েজ বিধায় অনেক মিল রয়েছে। আমার বইয়ের কাজে আমাকে হিব্রু বর্ণমালা ও উচ্চারণ খুব কাছ থেকে স্টাডি করতে হয়েছিল, প্রাচীন নামগুলো সঠিকভাবে লিখতে পারার জন্য। এজন্য ‘মেটা’ নিয়ে করা নিউজগুলো আমার কাছে খুবই হাস্যকর লাগছিলো।

অথচ কেউ সেটি পয়েন্ট আউট করেনি কোনো খবরেই, এটা আরও বিরক্তিকর ছিল- তারা কেবল ট্রলটুকুই উল্লেখ করে। ‘মেৎ’ বা ‘মেতা’ এসেছে হিব্রু ‘মাভেৎ’ বা ‘মায়েৎ’ (מָוֶת) থেকে, যার মানে ‘মৃত্যু’।

আমি এ শব্দটা বিশ্লেষণ করে দিই, যারা হিব্রু প্রথম দেখছেন তাদের জন্য- আরবির মতো হিব্রুও ডান থেকে বামে পড়তে হয়। ডান থেকে প্রথম অক্ষর হলো আরবি ‘মিম’ এর মতো হিব্রু ‘মেম’ (מ), নিচে T এর মতো চিহ্নটি হলো আরবি ‘যবর’-এর মতন ‘আ’।

এরপরে মাঝের অক্ষরটি হলো আরবি ‘ওয়াও’-এর মতোই, ‘ওয়াও’ বা ‘ভাভ’ (ו), এর নিচে তিন ফোঁটা মানে ‘এ’ উচ্চারণ। শেষে ‘তাভ’ (ת) যার উচ্চারণ ‘ত/ৎ’। উচ্চারণ দাঁড়ালো ‘মায়েৎ’। আরবিতে যা ‘মাওৎ’ (موت) বা ‘মৃত্যু’। হায়াত-মাওৎ।

হিব্রুতে দু’ রকম ‘ত/ৎ’ আছে, কোনো ‘ট’ নেই। বাংলাতে যেমন ‘ৎ’ আছে, ‘ত’ আছে, ‘ট’ আছে, ‘ঠ’ আছে। মধ্যপ্রাচ্যীয় সেমিটিক ভাষায় এত কিছু থাকে না। খোদ ইংরেজিতেই এত কিছু নেই।

সেই হিসেবে বাংলা বেশ শক্তিশালী ভাষা। হিব্রুর মতো আরবিতেও ‘ত’ দু’রকম, ‘তা’ (ت‍ / ‍ت) ও ‘ত্বোয়া’ (ط)। হিব্রুতে যে দু’রকম আছে বললাম, এর একটি হলো ‘তেৎ’ (ט); আর অন্যটি হলো ‘তাও’ বা ‘তাভ’ (ת)। ‘তাভ’-এর ব্যবহার আমরা বেশি দেখতে পাই, হিব্রুর ২২টি বর্ণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বর্ণের তালিকায় ‘তাভ’ সপ্তম।

যেমন, ইসরাইলের সাবেক রাজধানী তেল-আভিভ (תֵּל אָבִיב) বাংলায় প্রায় সঠিকভাবে আমরা লিখতে পারি, কিন্তু ইংরেজি উচ্চারণ হয়ে যায় ‘টেল আভিভ’। হিব্রুতে ডান দিকের প্রথম অক্ষর দেখুন, ‘তাভ’ (תֵּ) ব্যবহার করা হয়েছে; নিচের দুটো ফোঁটা ‘এ’ উচ্চারণ দেয়।

আরবিতে যের যবর পেশ এ তিনটি স্বর থাকলেও, হিব্রুতে এগুলোর পাশাপাশি ‘ও’ এবং ‘এ’ রয়েছে।

এটা সত্য যে এক ভাষার বুলি অন্য ভাষার গালি হতেই পারে। তবে সরাসরি ‘মেটা’ উচ্চারণে কোনো শব্দ সেমিটিক আরবি বা হিব্রুতে নেই। কিন্তু ‘মেটাট্রন’ নামে এক অ্যাঞ্জেলের নাম ইংরেজিতে লেখা হয়, যা হিব্রু থেকেই এসেছে।

ইহুদী ধর্মে এ ফেরেশতার নাম মেতাৎ-রোন (מֶטָטְרוֹן‎‎), যার কাজ সৃষ্টির শুরু থেকে কী হচ্ছে না হচ্ছে, যা যা হবে- সব লিপিবদ্ধ করা (কোনো কোনো ইহুদী উপকথায় নবী ইদ্রিস আঃ-কে এ নামে ডাকা হয়)। খুব গভীরে খুঁজলে ইসলামি লেজেন্ডেও আপনি ‘মীতাৎরূন’ (ميططرون)-এর খোঁজ পেয়ে যাবেন। আরবি ও হিব্রুতে তার নাম যথাক্রমে ত্বোয়া/ত্বা (ط) ওর ‘তেৎ’ (ט) দিয়ে লিখা। যাক গে, সে অন্য এক প্রসঙ্গ।

যথেষ্ট অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান দিয়ে ফেলেছি। তবে ফেসবুকের ‘মেটা’ আসলে গ্রিক ‘মেটা’ (μετα-) থেকে এসেছে, যার মানে “after” বা “beyond”।