বাংলাদেশে মার্কেটিং শিক্ষার সিলেবাস কেমন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ মার্কেটিং এর কোর্স প্ল্যান দেখে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছি।

উক্ত বিভাগে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী জানালেন, মার্কেটিং মেজর হলে কি হবে? ২য় সেমিষ্টারেই তাদেরকে নাকি ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি , বায়োলজি সবই পড়তে হয়। জেনারেল সায়েন্স এন্ড এনভার্ণমেন্ট নামের একটা বিষয়ের অধীনে তারা পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের বেসিক পাঠ দেয়া হয়। সিলেবাসে দেখলাম নিউটনের মোশন ল, গ্রাভিটি, মলিকিউলার এনার্জি – এইসব টার্মগুলা! জিগেস করলাম, তোমাদের নিশ্চয়ই এস্ট্রোনমিও পড়ানো হয়? কিংবা জুওলজি? এনথ্রোপলজিই বা বাদ যাবে কেন?

কমেন্টের ঘরে ছবিগুলা দিলাম। আমি হতভম্ব! কারণ মার্কেটিংয়ের সাথে এগুলার কি সম্পর্ক সেটা নিয়ে আমার কোন ধারনা নেই। কারো থাকলে আমাকে জানাবেন প্লিজ।

যা বুঝলাম, অন্যান্য প্রাইভেট ভার্সিটির বিবিএর কোর্স প্ল্যানের সাথে ঢাবির বিবিএর কোর্স প্ল্যানের কিছুটা বৈসাদৃশ্য আছে। যেমনঃ বাংলাদেশ স্টাডিজ, জেনারেল সায়েন্স এন্ড এনভার্ণমেন্ট, টুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, ইন্স্যুরেন্স ও রিস্ক ম্যানেজমেন্ট – এসব আমার জানা মতে দুনিয়ার কোন ইউনির মার্কেটিং মেজরে পড়ানো হয় না। বিশেষ করে শেষের দুটো বিষয়ের জন্য আলাদা ডিপার্টমেন্ট থাকে, নরমালি ডিপ্লোমা।

প্রসঙ্গত একটা ব্যাপার বলে রাখি, মার্কেটিংয়ের বইগুলো আসলে খুবই রিজিওন স্পেসিফিক। যেমনঃ ভারতীয় উপমহাদেশে যে সব মার্কেটিংয়ের বই পড়ানো হয়, সেগুলো ভুলেও কখনো ইউরোপ-আমেরিকার জন্য প্রযোজ্য হবে না।

এই কারণে আমরা যখন পড়েছি, তখন বইয়ের উপর বড় বড় করে লেখা থাকতো Only for Australia and New Zealand। এর কারণ হচ্ছে, একটা নির্দিস্ট ভৌগোলিক অবস্থানে থাকা একটা নির্দিস্ট জাতিসত্তার জন্য মার্কেটিংয়ের বইগুলো লেখা হয়ে থাকে। যেগুলো অন্য কোন ভৌগোলিক অবস্থানে থাকা অন্য কোন জাতিসত্তার জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে।

অপরদিকে, আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে – উপরের ৪টি বিষয় ছাড়াও আরো কয়েকটি বিষয় আছে, সেগুলো মার্কেটিং মেজরে পড়ানোটা একেবারেই বাহুল্য, স্রেফ সময় ও টাকার শ্রাদ্ধ! যেমনঃ

1. ফাইন্যানসিয়াল একাউন্টিং

2. টেক্সশন ও অডিটিং (উপরেরটাসহ এইটা একাউন্টিং মেজরের সাবজেক্ট)

3. হিউম্যান রির্সোস ম্যানেজমেন্ট (মার্কেটিংয়ের উর্দ্বতন অফিসার হলে আপনি এইটা নিজের ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়েই এর চাইতে ভালো বুঝবেন, তার উপর কোম্পানির এইচআর বিভাগ তো থাকবেই!)

4. ইকোনমিক্স

5. ব্যবসায় পরিসংখ্যান (শুধুমাত্র মার্কেটিং রিসার্চে লাগে, তাও এখন অনেক পাওয়ারফুল সফটওয়্যার আছে, যেমনঃ IBM SPSS, এটা ভালো করে অপারেট করতে জানলে আলাদা করে ক্রেডিট খরচা করে পরিসংখ্যান শেখার কোন দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।)

6. Legal Aspects of Marketing (আইনের ব্যাপারটা আদতে একেক দেশে একেক রকম। এটার তেমন কোন সিলভার বুলেট ফর্মূলা নেই। যেমনঃ এরশাদ আমল থেকে বাংলাদেশে ওষুধের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ। কিন্তু অন্য দেশে নিষিদ্ধ নাও হতে পারে।

তাছাড়া, বড় ও মাঝারি কোম্পানিতে আলাদা করে আইনজীবিই রাখা হয়। আর বেসিক যে আইন-কানুন আছে, সেটা আমার ধারনা মাস খানেক ক্লাস করলেই পুরোপুরি আয়ত্তে আনা সম্ভব। এটার জন্য আস্ত একটা ক্রেডিট ব্যবহার করা মানে ক্রেডিটের নিদারুন অপচয়।)

এই ফাকেঁ বলে রাখি, Quantitative Business Analysis -কে অনেকেই অদরকারী বলে মনে করেন। কিন্তু সত্যিটা হলো, পণ্যের মূল্যমান নির্ধারণ করতে এই বিষয়ের উপর সম্যক ধারনা প্রয়োজন। পণ্যের মূল্যমান নির্ধারণ করাটা এককভাবে কোম্পানির মার্কেটিং টিমের দায়িত্ব। এবং এই কাজটি যথেষ্ঠ জটিল।

ঢাবিতে ”সেলসম্যানশীপ” নামে আলাদা একটা সাবজেক্ট আছে, যেটা প্রাইভেট ইউনির বিবিএতে আছে বলে আমার মনে হয় না। ঢাবিতে পড়ানো হয়, ব্যাপারটা ভালো লাগসে। কারণ বাংলাদেশে সেলস না জানলে মার্কেটিংয়ের জব পাওয়া যায় না। যদিও সব মার্কেটারই কোন না কোনভাবে একজন সেলসম্যান, কিন্তু সব সেলসম্যান মার্কেটার নন।

তবে ঢাবিতে শেষ বর্ষের ২য় সেমিষ্টারে সার্ভিস মার্কেটিং, কনজুমার বিভেবিয়ার, মার্কেটিং রিসার্চ, ইন্টারন্যাশনার মার্কেটিং, ট্রেড মার্কেটিং, ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্ট এর মতো একদম মাক্ষন সাবজেক্টগুলা পড়ানো হয়। কিন্তু সিলেবাসে ”এডভারটাইজিং” সাবজেক্টটটা নাই কেন বুঝলাম না ঠিক!

যা হোক, আমাকে যদি বিবিএর সিলেবাস প্রণয়ন করতে দেয়া হয়, আমি শুরুতেই উপরের ১০টা আপাতঃ অপ্রয়োজনীয় ও স্বল্প প্রয়োজনীয় সাবজেক্টগুলো বাদ দিয়ে এর বদলে নিচের অতি প্রয়োজনীয় সাবজেক্টগুলো অন্তর্ভুক্ত করবো, যেগুলোর অনেকগুলোই বিদেশের ভার্সিটিগুলোর গ্রাজুয়েশন প্রোগ্রামে রাখা হয়। যেমনঃ

Digital Marketing (এইটা এত বেশী গভীর যে, পুরো একটা গ্রাজুয়েশন প্রোগ্রামের কোর্স আউটলাইন করা পসিবল শুধু এই একটা সাবজেক্ট দিয়েই!)। কিন্তু আমি বেসিকটা শেখার জন্য ৮ টা সেমিস্টার ডিজাইন করবো, যা ২ থেকে আড়াই বছরেই শেষ করা সম্ভব!) এর অধীনে থাকবেঃ

1. Search Engine Marketing & SEO (2 Semester)

2. Content Marketing & Content Writing (1 Semester)

3. Social Media Marketing & Advertising (Half Semester)

4. ডিরেক্ট মার্কেটিং – SMS/E-mail MKT (Half Semester)

5. Affiliate MKT/Referral MKT (Half Semester)

6. Copywriting (Half Semester) – যারা লেখালেখি করে অভ্যস্ত ও কবি – এদের জন্য পারফেক্ট ক্যারিয়ার। ওয়েব কপিরাইটারের ডিমান্ড ক্রমবর্ধমান।

7. Influencer Marketing (Half Semester) – এটা নিয়ে আমার আলাদা পোষ্ট রয়েছে। কমেন্টে লিংক।

8. Growth Hacking Marketing (Half Semester) – উদ্যোক্তাদের জন্য এই সাবজেক্ট পড়া মাস্ট!

9. Emotional Storytelling (Half Semester) – স্টোরি টেলিং এত বেশী শক্তিশালী একটা মাধ্যম যে এটার জন্য আমি আলাদা একটা সাবজেক্টই রাখবো।

10. Design Thinking & Product Designing (Half Semester) – কিভাবে এডিকটিভ পন্য ডিজাইন করতে হয়, সেটা এখানে শিখানো হবে।

11. Marketing Consultancy Project (1 Semester) – একটা কোম্পানির রিয়েল লাইফ মার্কেটিং কনসালটেন্সি করতে দেয়া হবে। এতে করে শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে জ্ঞান হবে যে পুরো মার্কেটিং প্রসেসগুলো কিভাবে ইন্টারকানেকটেড!

ফাইন্যানসিয়াল একাউন্টিং, টেক্সশন ও অডিটিং, ব্যবসায় পরিসংখ্যান, হিউম্যান রির্সোস ম্যানেজমেন্ট, ল – এইসব পড়ার চাইতে একজন মার্কেটিং মেজরের শিক্ষার্থীর জন্য ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের এই ১০ টি সাবজেক্ট পড়া অনেক অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ, ট্রাষ্ট মি!

ডিজিটাল মার্কেটিং সাবজেক্টটা ইন্টারনেট মার্কেটিংয়ের অংশ, এবং আগামী ৫ বছরের মধ্যে পৃথিবীর খুব খুব কম কোম্পানিই এর আওতার বাইরে থাকবে। এই কারণেই পৃথিবীর সব কয়টা ডাকসাইটে ইউনির মার্কেটিং মেজরে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কোন না কোন সাবজেক্ট এক্সটেনসিভলি পড়ানো হয়।

অথচ আমার জানা মতে, বাংলাদেশের কোন পাবলিক ভার্সিটির কারিকুলামে এই সাবজেক্টগুলা নাই। আফসোস।

এছাড়াও, পড়াশোনার পাশাপাশি আমার প্রণীত সিলেবাসে নিয়মিত বিরতিতে পেইড ওয়ার্কশপ ও সেমিনারের আয়োজন থাকবে। যেখানে নিজেদের রিয়েল লাইফ অভিজ্ঞতা শেয়ার করবেন নীচের পদবীধারীগণঃ

1. Sales Promotion Manager
2. PR Manager
3. Product Manager
4. Ad Agency Supervisor
5. Creative Head
6. Brand Manager
7. Chief Marketing Officer
8. Marketing Research Specialist

এদের কারো কারো জীবনের অভিজ্ঞতা এতটাই মূল্যবান যে, এটা শুনে শিক্ষার্থীরা যে জ্ঞান আহরণ করবে, তা হয়তো তারা সারা বছর পড়াশোনা করেও পারবে না – (যা তাদের পেশাগত জীবনে ইনক্রেডিবলি হেল্প করবে।)

কিংবা, তার চাইতেও দুঃখজনক বিষয় যে, যখন তারা আবিস্কার করবে যে এতদিন যা তারা ক্লাসে শিখেছে, সেগুলো বর্তমানে আর চর্চা করা হয় না, অবসোলেট হয়ে গেছে; কিংবা ভুল-ভাল শিখেছে – যার সাথে বাস্তবতার মিল খুব সামান্যই।

আরেকটা ব্যাপার হলো, পাশ করে বের হবার পরে অধিকাংশ শিক্ষার্থী বুঝে না তারা কি এখন কি করবে? তাদের মার্কেটিং সার্টিফিকেট তাদের কি কাজে আসবে, বা আদৌ কোন কাজে আসবে কিনা। তাই বেশীরভাগই খুব মানবেতর বেতনে কোনমতে একটা কোম্পানির সেলস এক্সিকিউটিভ পদে ঢুকে যায়।

তাদের জন্য আমার সিলেবাসে থাকবে ফ্রি ক্যারিয়ার কনসালটেন্সি সার্ভিস। যেমনঃ

ক) যারা আরো উচ্চতর পড়াশোনা করতে চায়, তাদের জন্য থাকবে Master of Business Administration (MBA) specializing in marketing, or MSc in Digital Marketing or International Marketing Management, Or The Marketing Philosophy, Or Ethical Marketing এ ভর্তি হবার সুযোগ!

খ) যারা প্রফেশনাল ডিগ্রী নিতে চায়, তাদের জন্য – The Chartered Institute of Marketing (CIM), or the Chartered Institute of Public Relations (CIPR) এ ভর্তি হবার সুযোগ। তবে এক্ষেত্রে মার্কেটিং ফিল্ডে কয়েক বছরের পেশাগত যোগ্যতা বেশ ভালো ফল দেয়।

গ) যারা এমবিএ করার আগে কয়েক বছর জব করতে চায়, তাদের জন্য থাকবে এড ফার্ম, ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি, বা কোন কোম্পানির মার্কেটিং টিমে জয়েন করার সুযোগ।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সরাসরি যোগাযোগ থাকবে এনলিষ্টেড কোম্পানির এইচআর বিভাগ, তারা সরাসরি আমার ডিপার্টমেন্ট থেকে আমার রিকোমেন্ডশনে নিজেদের কোম্পানির জন্য ট্যালেন্ট রিক্রুট করতে পারবে।

ঘ) যারা উপরের কোনটাই না করে গ্রাজুয়েশনের পর পরেই উদ্যোক্তা হতে চায়, তাদের জন্য থাকবে নিজস্ব এজেন্সি খুলতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা (নির্দিষ্ট ফিয়ের বিনিময়ে)। আমার প্রণয়ন করা অনেক সাবজেক্টই তাদেরকে মারাত্নক সাহায্য করবে নিজেদের এজেন্সি বা স্টার্টাপ গড়তে ও চালাতে।

আমি মোটেও কোন শিক্ষাবিদ নই, আমি অতি সামান্য একজন মার্কেটার। সেই আমিই যদি এই যুগপোযগী ও মুটামুটি মানের একটা কোর্স প্ল্যান ডিজাইন করতে পারি, তাহলে যারা অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ রয়েছেন, তাদের জন্য এর চাইতেও অনেক বেশী অপটিমাইজড প্ল্যান করা তো কোন বিষয়ই না।

আমি মনে প্রাণে চাই এই দেশের মার্কেটিং কারিকুলামকে ঢেলে সাজানো হোক, আধুনিক করা হোক। স্রেফ সার্টিফিকেটের জন্য না পড়ে শিক্ষার্থীদেরকে স্কিলড ফোর্স হিসেবে গড়ে তোলা হোক, যাতে করে তারা পৃথিবীর যে কোন জাগায় তাদের অর্জিত জ্ঞানকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারে।

স্বল্প প্রয়োজনীয় সাবজেক্টগুলো দিয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যবান সময় ও অর্থের অপচয়ের কোন মানেই হয় না, যেখানে এত এত অতি দরকারী সাবজেক্ট এখনোও অপঠিত রয়ে গেছে। আমি ভেবেছিলাম, এই বিষয়ে আরো কিছু লিখবো, কিন্তু পরে মনে হলো, এর চাইতে বেশী কিছু লিখলে চাকরী থাকবে না।