দেশীয় ব্রান্ড ও ব্রান্ড এম্বাসেডরঃ নৈতিকতার দ্বন্দ্ব, পেশাদারিত্ব ও বাস্তবতা

Evaly Tahsan

গতকাল একটা গ্রুপে ইভ্যালির একটা প্রিন্টেড বিজ্ঞাপনের ছবি পোষ্ট করা হয়েছে। কমেন্টের ঘরে অনেকেই বেশ রসাত্নক কমেন্ট করেছেন।

তবে আমি দুইটা জিনিস খেয়াল করলাম এই ঘটনায়।

১. অনেকেই তাহসানের নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। তাদের বক্তব্য হলো, ইভ্যালির সাথে চুক্তি করাটা তাহসানের উচিত হয়নি। একজন খুব শ্লেষাত্নক মন্তব্য করেছেন – “টাকার জন্য এসব সেলিব্রিটিরা দেখি বাটপারদের হয়ে মার্কেটিংও করে! অবশ্য ভাড়া খাটা পাব্লিকদের কাছে এর বেশী কিই বা আশা করা যায়!”

আমার অভিমত হলো, সে তো ”পেশাদার” ব্যক্তিত্ব। টাকার বিনিময়ে সে গান গায়, মডেল হয়, ব্র্যান্ড এম্বাসেডর হয়, অভিনয় করে। এমনকি শিক্ষকতাও সে করে সন্মানির বিনিময়েই। কোন কাজই সে কিন্তু মুফতে করে না। তার কোন দাবত্য সংস্থাও নেই।

তার মানে হলো, যে তাকে টাকা দিবে, তার হয়েই সে কাজ করবে, যদি না সেটা আইনতঃ কোন অবৈধ সংগঠন বা ব্র্যান্ড হয়ে থাকে। আমার এক ফ্যাশন ব্যবসীয় ক্লায়েন্টের ব্র্যান্ড এম্বাসেডর হবার জন্য তাহসানের ম্যানেজারের সাথে যোগাযোগ করলে ক্লায়েন্টকে কোট করা হয়েছিলো ৫০ লাখ টাকা (১ বছরের চুক্তি)।

শুনেছি ইভ্যালির সাথে তার প্রায় ৩ কোটি টাকার চুক্তি হয়েছে। জানি না সত্যি কিনা।

২. ইভ্যালির এথিকাল অবস্থান অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ, সন্দেহ নেই। এই কারণেই তাহসানকে নিয়ে ইভ্যালির প্রায় প্রতিটি সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট তুমুল হাহা রিএ্যাক্ট থাকে। অর্থাৎ, ইভ্যালি তার কাষ্টমারদের আহ্বান জানাচ্ছে তাদের উপর বিশ্বাস রাখতে, কিন্তু তাহসানকে দিয়ে Believe in You নামক তাদের এই নতুন ব্র্যান্ড মোটোর যাত্রা শুরু করেও তারা ঠিক হালে পানি পাচ্ছে না। বরং ব্যাকফায়ার করছে। মানে লোকে বিশ্বাস তো করতে পারছেই না, বরং বিদ্রুপ ও হাসি ঠাট্টা করছে।

হারানো ইমেজ ফিরে পেতে ইভ্যালি তাহসানের পরিপাটি ভদ্রলোক ইমেজ ব্যবহার করতেই তাকে নিয়োগ দিয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু যে পরিমান টাকা দিয়ে সেলিব্রেটি ব্র্যান্ড এম্বাসেডর হায়ার করা হয়েছে, সে পরিমান টাকা সার্ভিস রিকভারীর পেছনে ইনভেস্ট করলে আরো অনেক বেশী ফলপ্রসু হতো বলে বিশ্বাস করি। গত বছর যেটা বিকাশ করেছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে তাদের চার্জ বেশী বলে ব্যাপক গুঞ্জন উঠার পর তারা কিন্তু কোন ব্র্যান্ড এম্বাসেডর হায়ার করেনি। বরং তাদের সেবাকে আরো স্মার্ট করেছে। QR code চালু করলো, ঋন সুবিধা চালু করলো, সম্প্রতি টাকা পাঠানোও ৫ জনের জন্য ফ্রি করে দিলো। এইসব করে তারা সোশ্যাল সেন্টিমেন্ট ম্যানেজ করে ফেলল।

প্রিন্টেড সেই ছবিটি। এই বিজ্ঞাপন নিয়ে আপনার মতামত জানাতে পারেন কমেন্ট সেকশনে

তাহসানের পেছনে ইভ্যালির এই বিপুল বিনিয়োগের ROI কেমন পাওয়া যাচ্ছে, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে। সেটা আমার এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমার প্রশ্ন হলোঃ

ক. কোন সেলিব্রেটি যদি কোন ব্র্যান্ডের এম্বাসেডর হবার ক্ষেত্রে নৈতিক অবস্থান না নেয়, সেক্ষেত্রে তাকে সরাসরি এই অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায় কিনা? মানে নৈতিক ব্যাপারটা তো আপেক্ষিক, এবং কাউকে দিয়ে জোর করে করানো যায় না যদি না তার এই ব্যাপারটা নিজের ভেতর থাকে।

খ. সংশ্লিষ্ট সেলিব্রেটির নিজস্ব ব্র্যান্ড ইমেজ এতে আহত (কিংবা নিহত) হয় কিনা? মানে ইভ্যালির কারণে তাহসানের নিজস্ব জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামবে কিনা? (খেয়াল রাখতে হবে, যারা তার একনিষ্ঠ ফ্যান, তারাও এখন তাকে বিদ্রুপ করছে!)। আমাদের দেশে এমন আর কোন উদাহরণ কি দেয়া যাবে যেখানে ব্র্যান্ডের সাথে সংশ্লিষ্টতায় সেলিব্রেটির নিজের ইমেজেরই বারোটা বেজেছে?

গ. কিংবা ভাইস ভার্সা, মানে আমাদের দেশীয় সেলিব্রেটি-স্ক্যান্ডালের ঘটনায় ব্র্যান্ড নিজেই চুক্তি করার পর সরে এসেছে, অর্থাৎ, চুক্তি বাতিল করেছে, এমন উদাহরণ আছে কি? এমন কোন উদাহরণ আমার আপাততঃ মনে পড়ছে না। বরং উল্টো উদাহরণ দেয়া যাবে। যেমনঃ ২ বছর আগে আমরা দেখেছি যে, সাকিব আল হাসানকে যখন নিষিদ্ধ করা হলো, তখন কোন ব্র্যান্ডই তার সাথে চুক্তিতো বাতিল করেই নি, বরং নতুন কয়েকটা ব্র্যান্ড তার সাথে নতুন করে চুক্তি করেছে। এই ব্যাপারটা আমার কাছে বড্ড ইন্টারেস্টিং লেগেছে।

এর কারণ হিসেবে দেশের শীর্ষ একটি বেভারেজ ব্র্যান্ডের ব্র্যান্ড ম্যানেজার আমাকে জানিয়েছিলেন, দেশের কোন ব্র্যান্ড কখনই চায় না কোন সেলিব্রেটির সাথে সামান্য কিছু টাকার জন্য রিলেশন খারাপ করতে। অপরদিকে বাংলাদেশে এক সাকিব আর তাহসান ছাড়া পাতে তোলার মতো তেমন সেলেব কই? মানে ব্র্যান্ড চুক্তি বাতিল করে যে অন্য আরেকজনকে হায়ারা করবে, সেই সুযোগও তো সীমিত।

এই সীমাবদ্ধতার একটা ভালো দিক হলো, একজন সেলেবকে ব্র্যান্ড এম্বাসেডর হিসেবে নিয়োগ দিয়েই মুটামুটি পুরো মার্কেট কভার ফেলা যায়, যেটা ভারতের মতো দেশে অত্যন্ত কঠিন, কারণ সেখানে সেলিব্রেটির ছড়াছড়ি! তাছাড়া, আমরা যেহেতু জাতি হিসেবে গোল্ড ফিশের মেমরী ধারন করি, সেহেতু কিছুকাল পরে যখন সেলিব্রেটির কেলেংকারির কথা লোকে ভুলে যাবে, তখন কিন্তু চুক্তি-বাতিল-করে-দেয়া ব্র্যান্ডটিকে উক্ত সেলেব আর কোন সুযোগ দিবেন না।

অথচ অষ্ট্রেলিয়াতে আমি দেখেছি, এই রকম ঘটনায় ব্র্যান্ড চোখ বুজে কনট্রাক্ট ক্যানসেল করে থাকে। একজন সকার (ফুটবল) প্লেয়ার হঠাৎ একদিন ড্রিংক ড্রাইভিং করে ধরা পড়লো হাইওয়ে পেট্রোলের হাতে। ঐ দেশে ড্রিংক ড্রাইভিং হচ্ছে ক্রিমিনাল অফেন্স, মানে একেবারে ফৌজদারী অপরাধ। পুলিশ মোটা অংকের ফাইন দিলো, ড্রাইভিং লাইসেন্সের পয়েন্টও কাটলো, এবং সতর্ক করে দিলো, পরের বার একই অপরাধে ধরা পড়লে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স তিন বছরের জন্য বাতিল হয়ে যাবে।

মজার ব্যাপার হলো, এই ঘটনার কিছুদিন আগেই ভিক্টোরিয়া বিটার(অষ্ট্রেলিয়ার নাম্বার ওয়ান বিয়ার ব্র্যান্ড) এর সাথে উক্ত খেলোয়ারের প্রায় ১ মিলিয়ন ডলারের এন্ডর্সমেন্টশিপ চুক্তি হয়েছিলো। কিন্তু পরদিন পত্রিকায় তার মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার এই সংবাদ প্রকাশের মাত্র ৪৮ ঘন্টার মধ্যে VB তাদের সেই চুক্তিটি বাতিল করে দেয়। এটা যতদূর মনে পড়ে গত দশকের ঘটনা। এটি সে সময় স্থানীয় মিডিয়ায় বেশ সোড়গোল তুলেছিলো।

আমি সিডনীতে ছিলাম প্রায় ৮ বছর। ইউনিভার্সিটির ক্লাস শেষ করে চাকরিতে যেতাম, রাত ১২টায় বাসায় ফিরে টিভিতে টক শো দেখতে দেখতে ডিনার করতাম। একদিন দেখলাম, এটাই টকশোর টপিক। আনা হয়েছে ভিবির ব্র্যান্ড এম্বাসেডরকে। তাকে জিগেস করা হলো, কেন চুক্তিটি বাতিল করা হলো? সে চমৎকার এক জবাব দিলো – “যাতে করে ভিবির ব্র্যান্ড ইমেজে এই কলংকের দাগ না লাগে যে, ভিবির হায়ার করা তারকারা মদ্যপ থাকে। তাহলে সেটা সরাসরি ভিবির ব্র্যাান্ড ইমেজে আঘাত হানবে।

লোকে ভাবতে পারে, ভিবি খেলে মদ্যপ হয়, এবং মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে ধরা পড়ে ফাইনও খায়। পরোক্ষভাবে ভিবি ক্রিমিনাল অফেন্সকে এনকারেজ করছে। আমরা আমাদের ক্রেতাদের এমন কোন ধারনা দিতে চাই না বলেই আমরা চুক্তিটি বাতিল করেছি। এবং আমরা মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর পুরোপুরি বিরুদ্ধে!”

দিস ইজ কল্ড আ গ্রেইট পিআর!

উল্লেখ্য, VB বিয়ারে এলকোহলের পরিমান প্রায় ৫%! তার মানে আসলেই ড্রিংক ড্রাইভিংয়ের ঘটনাটা ভিবির ব্র্যান্ড ইমেজের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। তাই চুক্তি বাতিল করা ছাড়া উপায়ও ছিলো না তাদের। অপরদিকে উক্ত প্লেয়ার খুবই বিনয়ী ছিলেন, সে পুরো দায় স্বীকার করেছিলো সাংবাদিকদের কাছে। আর বলেছিলো, ”আমি হাসিমুখে ফাইন দিয়েছি, কারণ সেটা মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে রোড একসিডেন্ট করে অপঘাতে মরে যাওয়ার চাইতে ভালো!”

এমন না যে সেখানে কেউ মদ খেয়ে গাড়ি চালায় না, বরং এই ঘটনা অহরহ ঘটে। কিন্তু একজন সেলিব্রেটির জন্য এটা অত্যন্ত গুরুতর এক ঘটনা। এতটাই যে, শুধু ফাইন বা চুক্তি বাতিল করেই তার দুভার্গ্য শেষ হয়নি, স্বয়ং অষ্ট্রেলিয়ান সকার ফেডারেশনও তাকে লিখিতভাবে হুশিয়ারি দিয়েছিলো যে, আর একবার এই ঘটনা ঘটালে তাকে টিম থেকে চিরতরে বহিস্কার করা হবে।

আমার খুব ঘনিষ্ঠ একজন ভারতীয় ক্লাসমেট-বান্ধবী ড্রিংক ড্রাইভিংয়ে মারা গিয়েছিলো অত্যন্ত নৃশংসভাবে। লাশ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো! এ সমস্ত কারণেই ড্রিংক ড্রাইভিংয়ের বিরুদ্ধে NSW Police Dept কিন্তু খুব দারুন দারুন ক্যাম্পেইন চালায়। সারা বছরই বিলবোর্ড, ওভার দ্য হেড ব্যানার লাগিয়ে রাখে হাইওয়েতে!

কথা প্রসংগে একটা ঘটনা বলি, একবার গাড়ি ড্রাইভ করে মফস্বল একটা এলাকায় যাচ্ছিলাম এক কনভার্টেড অষ্ট্রেলিয়ান মুসলমানকে লিফট দিতে। পথিমধ্যে হাইওয়ে পেট্রোল আমার পথ আটকে দাঁড়ালো। হয়তো দুয়েক সেকেন্ডর জন্য স্পিডিং করছিলাম। আর পড়বি তো পড়, মালির ঘাড়ে?! তো বিথ্র টেষ্ট করার মেশিন এগিয়ে দেয়ার পর আমি নারী-পুলিশটিকে বল্লাম – ’আমি মুসলমান, আমি মদ খাই না’। সে জবাব দিলো – ”ডাজন্ট ম্যাটার!” তার চোখে দেখলাম এমন একটা ভাব – “আরে কত মুসলমান দেখলাম!”😞 যা হোক, ব্রিথ টেষ্ট করে আপত্তিকর কিছু না পাওয়াতে অল্প কিছু ফাইনের বরাতে সে যাত্রা বেচেঁ গিয়েছিলাম।

প্রশ্ন করতে পারেন, মদ খাওয়ার সাথে স্পিডিং করার কি সম্পর্ক?

মানুষ যখন জোরে গাড়ি চালায়, তখন সে সেটা তার ব্রেইন ও নার্ভ দিয়ে ফিল করতে পারে। কাজেই বিপদ আচঁ করতে পেরে সে স্পিড নিয়ন্ত্রন করে ফেলে। কিন্তু মদ্যপ অবস্থায় এটা করা যায় না, মানে তার ব্রেইন ও নার্ভ গাড়ির স্পিড একেবারেই ফিল করতে পারে না। যার ফলে গাড়ি থেমে আছে নাকি ১০০ কিমি গতিতে ছুটছে, সেটা সে বুঝতে পারে না। আর তখনি স্পিডিং করে, আর ধরা খায় পুলিশের হাতে। আর ধরামাত্রই পুলিশ মদ্যপ ড্রাইভারের মুখের গন্ধ পরীক্ষা করে মেশিন দিয়ে।

Brand
দেশীয় ব্রান্ড ও ব্রান্ড এম্বাসেডরঃ নৈতিকতার দ্বন্দ্ব, পেশাদারিত্ব ও বাস্তবতা – প্রলয় হাসান

লেখকঃ সাবেক কন্টেন্ট মার্কেটিং ম্যানেজার, হাংরিনাকি