বিল গেটস বনাম স্টিভ জবস : এক ঐতিহাসিক চুরির গল্প!

চুরিবিদ্যার মতো বড়ো বিদ্যায় যদি কেউ ধরা পড়ে হাতেনাতে, পাবলিকের প্যাদানি খেয়ে নির্ঘাত লাল দালানের বাসীন্দা হতে হবে চৌর্যশীল্পিকে। কিন্তু চুরি করে মহান হয়েছেন, অমর হয়েছেন ইতিহাসের পাতায়–এমন গল্প কেবল রবিনহুডের গল্পের পাতায়ই মেলে। বাস্তবে সেই মহান চোরদের ভূরি ভূরি উদহারণ কই?

একে বারে যে নেই, তা কিন্ত নয়, এমন কিছু নাম, যারা চৌর্যবৃত্তিকে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে ইতিহাসের নতুন দুয়ার উন্মোচন করেছেন। আর নিজেদের পরিণত করেছেন কালের নায়কে।

আধুনিক কম্পিউটার জগতের দুই নায়ক স্টিভ জবস আর বিল গেটস–তাঁদের মেধা আর উদ্ভবনী দক্ষতায় মানব সভ্যতা এক লাফে এগিয়ে দিয়েছেন কয়েক শ বছর। কিন্তু এই দুই মহান প্রযুক্তিবিদের বিরুদ্ধেই রয়েছে চুরির অপবাদ!

এক

বিশ্বসেরা প্রযুক্তি কোম্পানি অ্যাপল। যার পলিসি মেকার-স্টিভ জবস

২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫। জোয়ান শেবলে একটা পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। না আর দশটা ধনী আমেরিকন মেয়ের মতো বড় কোনো হাসপাতালে নয়। ছেলের জন্ম হল এক দাতব্যালয়ের ডাক্তারের ঘরে। অথচ শেবলের বাবা মস্ত ধনী মানুষ। শিশুর যে জন্মদাতা, সেই আবুল ফাত্তাহ জান্দালিব সিরিয়ার মস্ত এক তেল কোম্পানির মালিকের ছেলে। তারপরও তাঁদের পূত্রের জন্ম এভাবে অবৈধ সন্তানের মতো হলো কেন?

সত্যি বলতে কি, সেই সন্তান ছিল সমাজের চোখে অবৈধ! জান্দালিব আর জোয়ানার যে বিয়েই হয়নি!

আমাদের উপমহাদেশে এ ছেলের জন্ম হলে, হয়তো এর আশ্রয় হতো ডাস্টবিন কিংবা সুয়ারেজ লাইনের ড্রেনে। ভাগ্যিস আমেরিকা, নইলে সেই ছেলে বড় হয়ে গোটা বিশ্বের প্রযুক্তির ইতিহাস বদলে দিত কীভাবে?

স্টিভ জবসের জন্মটাই ছিল যেন আজন্ম পাপ। তাঁর বাবা-মায়ের ভালোবাসা মেনে নিতে পারেননি তাঁর ডাকসাইটে ব্যবসায়ী নানা। বাপের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেও জান্দালিবের সাথে সিরিয়ায় চলে গিয়েছিলেন জোয়ান। সেখানে ছিলেন দুমাস। সেখানেও তাঁরা বিয়ে করেননি! কিন্তু প্রকৃতির নিয়মগুলো মেনে উদ্দাম ভালোবাসাটা চলছিল ঠিকই। আর তারই ফল জোয়ানের গর্ভধারণ।

জান্দালিব চেয়েছিলেন অ্যাবার্শন করাতে। কিন্তু জোয়ানা তাতে রাজি হননি। চলে গিয়েছিলেন সানফ্রান্সিকোর এক ডাক্তারের কাছে। এই ডাক্তার অবিবাহিত বাবা-মায়ের সন্তানের একটা হিল্লে করেন। তাঁর কাছে বড়লোকেরা, নিঃন্তানেরা ছুটে আসেন ছেলে কিংবা মেয়ে দত্তক নিতে। কিছুদিন আগে পল জবস নামে এক সাবেক সৈনিক আর মোটর মেকানিক কথা বলে গেছেন সেই ডাক্তারের সঙ্গে। এবার কোনো ছেলে-মেয়ে হাতে এলেই যেন তাঁকে খবর দেন। নিঃসন্তান জবস দম্পতি তাকে দত্তক নিতে চায়।

জোয়ন যখন সন্তান জন্ম দিতে যান, তখন সেই ডাক্তার খবর দেন পল জবসকে। জানান একটা সন্তানের সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনি সেটাকে দত্তক নেবেন কিনা?

এক কথায় রাজি পল জবস। ডাক্তারকে বলেন কাগজ-পত্র প্রস্তুত করে আইনগত ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে। কিন্তু সন্তান জন্ম দেওয়ার পর জোয়ান গড়িমিসি করেন। তাঁর বাবা মৃত্যুশয্যায়। যেকোনো সময় পরপারের ডাক আসতে পারে। তাই আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে চান। বাবা মারা গেলে জোয়ান বিয়ে করবেন জান্দালিবকে। তখন আর সদ্যজাত সন্তানকে দত্তক দেওয়ার দরকার হবে না।

কিন্তু ততোদিনে যে আইনত পল জবস ছেলের দাবীদার হয়ে গেছেন। তাই মন না চাইলেও ছেলেকে ছেড়ে দিতে হলো। পল সেই ছেলেকে ঘরে নিয়ে গেলেন। নাম রাখলেন স্টিভ জবস!

স্টিভ জবস! একটা ইতিহাসের নাম, কালের নায়ক, যিঁনি বদলে দিয়েছেন পৃথিবীর ইতিহাস। যেমন করে একটা যুদ্ধ বদলে দেয় মহাকালের ইতিহাস, ইতিবাচক অর্থেই তেমনি করে পৃথিবীকে বদলে দিয়েছেন স্টিভ জবস নামের কালের মহানায়ক।

যিঁনি কম্পিউটারকে, কম্পিউটার প্রযুক্তিকে মাল্টিন্যাশন্যাল কোম্পানি আর গবেষণারের কবল থেকে বের করে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়। আর নিজে শূন্য থেকে বনে গিয়েছিলেন বিলিয়নিয়ারে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত অ্যাপল জগৎসরা কম্পিউটার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নাম। তাঁর মাথা থেকেই বেরোনো আইফোন এখন বিশ্বব্যাপী মানুষের আভিজাত্যের প্রতীক।

দুই

স্টিভের পথচলার শুরুটা মোটেও নিষ্কণ্টক ছিল না। বাবা সামান্য মোটর মেকানিক, বিত্তবৈভব ছিল না, তাছাড়া শৈববেই তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল তিনি দত্তক নেওয়া সন্তান। তাঁর আসল বাবা-মা তাঁকে ফেলে গেছেন। সুতরাং ছোটবেলা থেকেই একটা হীনমন্যতা নিয়ে বেড়ে উঠতে হয়েছে স্টিভকে।

যতই বড় হয়েছেন ততই সেই হীনমন্যতা বেড়েছে। লেখাপড়ায় মন বসাতে পারেননি। প্রযুক্তির নেশা তাঁকে পাগলের মতো হাতছানী দিয়েছে। হয়েছেন ড্রাগ আসক্ত।

কখনো গাঁজা কখনো এলএসডির মতো ভয়ঙ্কর মাদকের সর্বনাশা ছোবলে সপে দিয়েছেন নিজেকে। পরে তাঁকে অমানবিক, নিষ্ঠুর, একরোখা অথচ ভয়নাক আইডিয়াবাজ করে তুলেছিল এই হীনমন্যতা। এত কিছুর পরেও তিনি যে বিশ্বসেরা উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন, সেটা পৃথিবীর অনেক বড় পাওয়া।

মনে যতই খেদ থাক, নিজের আসল বাবা-মায়ের প্রতি যত ঘৃণাই পুষে রাখুন মনে, পল আর ক্লারা জবসকেই স্টিভ তাঁর আসল বাবা-মা মনে করতেন, তাঁদের অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন।

নিজের বাবা-মায়ের সম্পর্কে তাঁর অকপট ঊচ্চারণ ছিল, ‘ওরা শুধু আমার জন্য ডিম্বাণু আর শুক্রাণুর জোগানদাতা, এর বেশি কিছু নয়।’ স্টিভের কাছে পলই ছিলেন নায়ক।

লোকটার কারিগরি দক্ষতা, গাড়ি আর যন্ত্রপাতি সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান স্টিভকে মুগ্ধ করত। ছেলের আগ্রহের অমর্যাদা করেননি পল জবস। ছোট্ট স্টিভের হাতে তাই হাতুড়ি তুলে দিয়েছিলেন। না, বাপের পরিশ্রমের ভাগীদার হতে নয়, নিজের মতো যেন জীবনটাকে চালাতে পারে সেই সুযোগ স্টিভকে করে দিয়েছিলেন পল। গাড়ির প্রতি, গাড়ির যন্ত্রপাতির প্রতি স্টিভের অন্যরকম আকর্ষণ তৈরি হয়। সেই আকর্ষণটাই কৈশোরে ইলেকট্রনিকসের প্রতি স্টিভকে দুর্বল করে তোলে।

স্টিভদের বাড়ির কাছেই নাসার অ্যামিস রিসার্চ সেন্টার। পল জবস ছোট্ট স্টিভকে একদিন সেখানে নিয়ে যান। সেখানে অনেকগুলো কম্পিউটার ছিল।

অবশ্য আজকের কম্পিউটারের সঙ্গে সে সব কম্পিউটারের তুলনাই চলে না। কম্পিউটার মানে তখন মেইনফ্রেম কম্পিউটার বোঝায়। কতগুলো লোহার যন্ত্রপাতিতে ঠাসা একটা বিরাট যন্ত্র।

কীবোর্ড নেই, মাউস নেই, সফটওয়ারনেই–অনেকটা ঢাল নেই তলোয়য়ার নেই নিধিরাম সর্দার। সেই নখদন্তহীন কম্পিউটারগুলোই ছোট্ট স্টিভকে দারুণভাবে আকর্ষণ করে। জায়গাটা পালো অ্যালটো; ক্যালিফোর্নিয়ার এখনকার সিলিকন ভ্যালির জন্য বিখ্যাত।

স্টিভের বয়স যখন দশ, তখনই শুরু সেখানকার হাইটেক পার্ক বিপ্লবের। সেখানে তখন ঠিকানা গেঁড়ে বসেছে বিখ্যাত কম্পিউটার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এইচপি। প্রায় নয় হাজার ইঞ্জিনিয়ারের কর্মক্ষেত্র হয়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠানটি। সদ্য গড়ে উঠেছে ইন্টেলের মতো মেমরি চিপ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান।

ইন্টেল খুব শিগগিরই মাইক্রো প্রসেসর তৈরি করেছে। গড়ে উঠেছে আরো ৫০টা সেমিকন্ডাক্টর প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। আজকের ইলেকট্রনিক্সের প্রধান উপাদান চিপ। এসব চিপগুলো তৈরি হয় সেমিকন্ডাক্টর দিয়ে।

সেমিকন্ডাক্টর আবার তৈরি হয় সিলিকনের সাথে জার্মেনিয়াম নামে মৌল ভেজাল করে। এই দুইয়ে মিলে তৈরি হয় অর্ধপপরিবাহী বস্তু বা সেমি কন্ডাকটর। তাই সিলিকনই প্রধান উপাদান হয়ে ওঠে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে। ইলেকট্রনিক নিউজ নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকা নামের বিপ্লব ঘটায়।

তারা পালো অ্যালটো এলাকার হাইটেক পার্ক নিয়ে একটা ধরাবাহিক প্রতিবেদন ছাপায়। সেই ধারাবহিকটার নাম ছিল ‘সিলিকন ভ্যালি ইউএসএ’। ওই প্রতিবেদন থেকেই আজকের বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত সিলিকন ভ্যালির নামটা এসেছে। আর সেখানেই ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছেন প্রযুক্তি দুনিয়ার প্রবাদপুরষ স্টিভ জবস।

তিন

মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা-বিল গেটস

বিল গেটসের শৈশব ছিল একদম আলাদা। জন্মও প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার দূরে–ওয়াশিংটনের সিয়াটলে। বাবা উইলিয়াম গেটস ছিলেন নামজাদা আইনজীবি।

বিত্ত-বৈভবের ভেতরেই বেড়ে ওঠা গেটস স্কুল কলেজেও ছাত্র হিসেবে দারুণ ছিলেন। কিন্তু তাঁর একটা বদঅভ্যাস ছিল–যখন-তখন লাফিয়ে উঠতেন।

বাচ্চা ছেলের লাফিয়ে ওঠা মানা যায়। কিন্তু হবু স্ত্রী মেলেন্ডা গেটসের সাথে রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েও লাফিয়ে ওঠা!

একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হতো ব্যাপারটা। এটা নিয়ে স্বজনদের কম কথা শুনতে হয়নি। কিন্তু মুদ্রাদোষ তো আর একদিনে তৈরি হয় না, তাই পত্রপাঠ সেটাকে বিদায়ও করা যায় না।

সেদিনের সেই লাফানো ছেলেটাই পরবর্তীতে প্রযুক্তি দুনিয়ার সুপার জায়ান্ট হয়ে উঠেছিলেন। ইস্পাতদৃঢ় মনোবল, ক্ষুরধার বুদ্ধি আর সঠিক সব সিদ্ধান্ত মিলিয়ে প্রযুক্তি পণ্যের সুপারহিরোতে পরিণত হয়েছিলেন বিল গেটস। সেই হিরোইজম আজও অটুট।

স্কুল-কলেজের পাঠ শেষে বিল ভর্তি হন হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু পড়াশোনাতে ঠিকমতো মন বসে না।

প্রযুক্তি পণ্যে ভারি নেশা। হার্ভার্ডের আশপাশে অনেকগুলো কম্পিউটার সেন্টার গড়ে উঠেছে ততদিনে। মেইনফ্রেম কম্পিউটারে ভরা সে সব সেন্টার। শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান আর বড় বড় কোম্পানিগুলো ব্যবহার করার সামর্থ্য রাখত সে সব কম্পিউটার।

আসলে সাধারণ মানুষের সাধারণ কারবার তাতে চলত না তাতে। সাধারণ ডেটা-বিশ্লেষণ, দূর-বর্তার মোর্সকোড ডিকোড করতে আর টুকটাক হিসাব কষতে পারত ওগুলো।

স্টিভস জবসের ডান হাত যেমন স্টিভ ওয়াজনিয়াক, তেমনি গেটসের সঙ্গী পল অ্যালান। দুই হার্ভাডিয়ান বন্ধু ওরা। কম্পিউটার সেন্টারে গিয়ে সেসব কম্পিউটার ব্যবহার করতেন দুবন্ধুতে মিলে।

নিত্য-নতুন আইডিয়া মাথায় আসত সে সব করতে গিয়ে। তখন কম্পিউটারের সফটওয়্যার জিনিসটার কেউ নামই শোনেনি। ছিল না পার্সোনাল কম্পিউটারের ধারণাও।

১৯৭৪ সালে একটা অখ্যাত কোম্পানি আল্টেয়ার বেশ ছোটখাটো বক্সাকৃতির একটা কম্পিটার বাজারে আনে। নামে কম্পিউটার হলেও সেটা দিয়ে আহামরি গোছের কিছু করা যেত না।

সেটা আসলে দামি খেলনা বা ক্যালকুলেটারের সাধারণ রূপ বৈ কিছু নয়। এই আল্টেয়ারই দুই হার্ভেডিয়ান বন্ধুর মধ্যে ভবিষ্যতের বীজ বোপন করে দেয়।

উড়নচণ্ডী স্টিভ জবস যখন স্বপ্ন দেখেন এক দিন বিশ্বের প্রতিটা ঘরে পেঁছৈ যাবে একটা করে পার্সোনাল কম্পিউটার, ঠিকই একই সময়ে হার্ভার্ডের তরুণ বিল গেটস ভাবনার সঙ্গে কর্মও যুক্ত করে ফেলেন।

বিল গেটস ভেবে দেখেন, একটা প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ যদি আল্টেয়ারের সঙ্গে যুক্ত করা যায়, তাহলে হয়তো এটা দিব্যি কাজ করবে। বাড়ি ফিরে বন্ধু পল অ্যালেনের সঙ্গে কাজে লেগে গেলেন। অটোমেটিক পাঞ্চ মেশিনের সাহায্যে পুরু কাগজে ছিদ্র করে লিখে ফেললেন প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ। সেটার নাম দিলেন তাঁরা ‘বেসিক’।

সফটওয়ার তৈরি করে বসে থাকলেই তো চলবে না। ঠিক জায়গায় সেটা পৌঁছতে না পারলে তো বাজারে বিকোবে না। নিজেদের একটা কম্পিউটারও নেই যে, সফটওয়ারটা পরীক্ষা করে দেখবেন। একমাত্র ভরসা এখন অল্টোয়ার কেম্পানি।

কিন্তু প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজটা নিয়ে আল্টেয়ার কোম্পানিতে যেতে রাজি নন গেটস। বিলের চেহারা থেকে কৈশরের চিহ্ন তখনো মুছে যায়নি। দেখলে খোকা খোকা লাগে।

তাঁর ধারণা, কোম্পানির লোকেরা তাঁকে দেখে ছেলেমানুষ ভেবে বসতে পারে। কে জানে ছোটদের খেলনা ভেবে প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজটা চেক না করেই হয়তো ফিরিয়ে দেবে।

তাই গেটস চাইলেন একাই যান অ্যালেন। গায়ে-গতরে অ্যালেন বেশ গাঁট্টাগোট্টা। চেহারাতেও সাবালোকের ছাপ।

সাহস করে তাই অল্টেয়ারে একাই গেলেন অ্যালেন। কোম্পানিটির কর্তব্যক্তিদের বোঝাতে সক্ষম হলেন, কেন এই সফটওায়ারটা কম্পিউটারে ব্যবহার করা জরুরি।

অল্টেয়ারের কর্তারা এক অসীম সম্ভবনা দেখলেন এই প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের মধ্যে। তাই তাঁরা সেটা কিনতে রাজি হয়ে গেলেন। সঙ্গে কিছু পয়সা এসে জুটল গেটস আর অ্যালেনের হাতে।

অপ্রতিদ্বদন্দি অপারেটিং সিস্টেম প্রতিষ্ঠান:- মাইক্রোসফট

এরপর শুধই স্বপ্ন দেখা। পড়াশোনাতেও মন বসে না দুই বন্ধুর। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ অসমাপ্ত রেখেই তাই ব্যবসায় নেমে গেলেন গেটস-অ্যালেন জুটি। নিউ মেক্সিকোর অ্যালবুকার্কে একটা ছোট্ট দোকান ভাড়া করে সূচনা হলো বিশ্বের প্রথম সফটওয়্যার কোম্পানির। বিল সেটার নাম দিলেন মাইক্রোসফট।

চার

স্কুল জীবন শেষ হওয়ার আগেই এক অসামান্য প্রতিভাধর তরুণের সঙ্গে পরিচয় হয় স্টিভ জবসের। নাম তাঁর স্টিভ ওজনিয়াক। বছরে স্টিভের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়। স্টিভের ঘাড়ে যেমন যন্ত্রপাতির ভূত আছে, ওজনিয়াকও তখন ইলেকট্রনিকসের পোকা। তবে আর যাই হোক, ওজনিয়াক স্টিভের মতো উড়নচণ্ডী নন। রীতিমতো সৎ ও চরিত্রবান ভদ্রলোক। সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর দুই প্রতিভার এমন যুগলবন্দ্বী ইতিহাসে গণ্ডায় গণ্ডায় মেলে না।

স্কুলের পাট চুকিয়ে, কলেজের স্বাদ জীভে (আসলে জীবনে) লাগার আগেই স্টিভ পড়াশোনা ছেড়ে দিলেন। হিপ্পিদের মতো, ভারতীয় সাধুদের মতো জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে ফেললেন নিজেকে। ওদিকে ইলেকট্রনিকের প্রেমে মজে লাটে উঠেছে ওজনিয়াকের লেখাপড়াও। তিনি কাজ নেন একটা ইলেকট্রনিক কেম্পানিতে। পার্টটাইম। এরপর এক কম্পিউটার তৈরির কোম্পানিতেও।

দুজনের জমল বেশ। গলায় গলায় পিরিত যাকে বলে। ওজনিয়াক এটা-সেটা তৈরি করে তাক লাগিয়ে দেন। স্টিভ সে সব দেখে মজা পান, স্বপ্ন দেখেন। এর মধ্যে একটা বইয়ের এক আর্টিকেল পড়ে দুজনে শিখে নেন ফোন হ্যাক করার যন্ত্র ব্লু বক্স তৈরির নিয়ম।

নিজেরাই ভাঙা রেডিও থেকে পার্টস-পত্তর বের করে তেমন ব্লু বক্স যন্ত্র তৈরি করে ফেলেন। এই যন্ত্রই জবসের ভেতরের ব্যবসায়ী মানুষটার জন্ম দেয়। স্টিভ প্রস্তাব দেন, এটা তৈরি করে বিক্রি করলে কেমন হয়? ওজনিয়াকও রাজি। তাঁরা এক শ টার মতো ব্লু বক্স বিক্রি করলেন। তৈরিতে খরচ ৪০ ডলার। বিক্রি ১৫০ ডলারে। লাভ বড় মন্দ নয়।

এরপর জবসের জীবনে সিনেমার মতো একের পর এক ঘটনাবহুল ঘটনা ঘটে। আটারি নামের বিখ্যাত গেমস কোম্পানিতে চাকরি নেন, কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে বান্ধবিকে নিয়ে ভারতে আসেন।

খেয়ে না খেয়ে সাধুর আখড়ায় পড়ে থাকেন, গাঁজা খান, এলএসডি ট্যাবলেট গেলেন। সাতমাস পর আবার ফিরে যান যুক্তরাষ্ট্রে।

পাঁচ

২৯ জুন ১৯৭৫। ওজনিয়াকের বাড়িতে ডাক পড়ে স্টিভের। কেন এই ডাক? সেখানে গিয়ে তো স্টিভের চোখ ছানাবড়া! কী তৈরি করেছেন তাঁর বন্ধু!

ঘর ভর্তি ছড়ানো ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, শোল্ডারিং আয়রন, একটা খোলা টেলিভিশন মনিটর আর একটা টাইপ রাইটার। ওজনিয়াক স্টিভকে বললেন কাগজহীন টাইপরাইটারে একটা কিছু টাইপ করতে।

স্টিভ টাইপ করলেন আর অবাক হয়ে দেখলেন তিনি যা টাইপ করছেন সেগুলো টেলিভিশন মনিটারে লেখা হয়ে ভাসছে। কম্পিটার প্রযুক্তিতে সে এক মাহেন্দ্রক্ষণ!

এখন এই যুগে এসে আমরা কেউ কীবোর্ড আর মনিটর ছাড়া কম্পিউটার কল্পনা করতে পারি! এই কীবোর্ড-মনিটরের জন্ম হয়েছিল সেদিন ওজনিয়াকের ঘরে।

তবে অলটেয়ারের কম্পিউটারের মতো এটাতেও মাইক্রো প্রসেসর ছিল। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো বিলগেটস যে প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ বানিয়েছিলেন কাগজে পাঞ্চ করে, এখন আর সেটার দরকার হবে না।

ওজনিয়াকের কম্পিউটারে কীবোর্ডে টাইপ করেই প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ লেখা যাবে। ওয়াজনিয়াক বলেছেন, সেটা ছিল পার্সোনাল কম্পিউটারের জন্য ইউরেকা মোমেন্ট।

স্টিভ জবস তাঁর বাবার গ্যারেজে কিছুটা জায়গা চেয়ে নিলেন। সেখানে বসানো হয় কম্পিউটার তৈরির সরঞ্জাম। চলছে কম্পিউটর তৈরি, যেটা সদ্য বানিয়েছেন ওয়াজনিক। এটাতে ছড়ানো ছিটানো যন্ত্র ছিল। এখন সেটাকে একটা বাক্সে আবদ্ধ করার চেষ্টা চলছে।

কারণ স্টিভের ব্যাবসায়ী বুদ্ধি আবার চাগিয়ে উঠেছে। ব্লু বক্সের মতো বন্ধুর তৈরি কম্পিউটারটিকেও তিনি বিক্রি করতে চান। তাঁরা সেই কম্পিউটারের নাম দিলেন অ্যাপল।

বিশ্বসেরা প্রযুক্তি কোম্পানির হেডকোয়ার্টার:-অ্যাপল

প্রযুক্তি জগতে আপেল নামটা হাস্যকর মনে হতে পারে। কিন্তু স্টিভের সেটাই পছন্দ। এর একটা কারণ বোধহয় সদ্যই তিনি একটা আপেল বাগান থেকে ঘুরে এসেছেন। তার একটা ছাপ হয়তো মনে রয়ে গিয়েছিলেন।

এই কম্পিউটারের মেমোরি ছিল আলটেয়ারের ষোলগুণ, তার ওপর ছিল কীবোর্ড, ছিল মনিটর। সুতরাং স্টিভ ভেবেছিলেন ক্রেতাদের আকর্ষণ করার মতোই অনেককিছু আছে। কিন্তু বিধিবাম!

মাইক্রোপ্রসেসরের জগতে ইন্টেল তখনই একচেটিয়া রাজত্ব শুরু করেছে। অন্যদিকে স্টিভ আর ওজনিয়াক তাঁদের কম্পিউটারে ব্যবহার করেছেন তুলনামূলক সাশ্রয়ী মটোরোলার মাইক্রোপ্রসেসর।

সুতরাং ক্রেতা পেলেন না স্টিভরা। সাকুল্যে বিক্রি হলো দু শটার মতো কম্পিউটার। এর চেয়ে বেশি বিক্রি করার ক্ষমতাও অবশ্য ছিল না স্টিভদের। তাঁদের যে মূলধনই ছিল না।

সেই দু শ কম্পিউটার কিনেছিল একটা কোম্পানি। তারা আগেই দু শর চাহিদাপত্র দিয়েছিল। তখন স্টিভ আর ওজনিয়াক নিজেদের গাড়ি, ক্যালকুলেটর, টাইপরাইটার ইত্যাদি বেঁচে আর ধারদেনা করে বানিয়েছিলেন এগুলো। তাতে যে লাভ হলো তা দিয়েই শুরু হলো অ্যাপল কোম্পানির কার্যক্রম।

এরপর তাঁদের পরিকল্পনায় এলো অ্যাপল টু। স্টিভ চাইলেন তাঁদের কম্পিউটারের ক্রেতা যেন শুধু কম্পিউটারের কোম্পানিগুলো না হয়। তিনি এবার কম্পিউটার তুলে দিতে চান সাধারণ মানুষের হাতে।

এ জন্য সুন্দর মনোরম একটা প্যাাকেজ দরকার। স্টিভ চাইলেন এমন কিছু, যেন প্রথম দশর্নেই মানুষের নজর কাড়ে। তার আগে কোম্পানির ব্যাপারে একটা ফয়সালা দরকার।

এ জন্য স্টিভ আর ওজনিয়াক ফিফটি-ফিফটি শেয়ারে কোম্পানির মালিক হলেন। কিন্তু ওজনিয়াকের বাবার এটা পছন্দ নয়। তিনি মনে করেন অ্যাপলের প্রধান কারিগরই তাঁরই ছেলে। স্টিভ কিছুই করেনি। সে কথা স্টিভের মুখের ওপর তিনি বলেও দিলেন। আরও বললেন, এই কোম্পানিতে স্টিভের কোনো অধিকারই নেই। স্টিভের উচিৎ ওজনিয়াকের হাতে সব ছেড়ে দিয়ে কেটে পড়া।

স্টিভ ভাবলেন, ওজনিয়াকের বাবার কথা মিথ্যে নয়। অভিমান নিয়ে সরে পড়তে চাইলেন তিনি। কিন্তু ওজনিয়াক তাঁর বাবার মতো নন। আজও তিনি-সৎ নিপাট ভদ্রলোক। তিনি স্টিভের মান ভাঙালেন। আর বোঝালেন, তৈরি হয়তো তিনি করেছেন, কিন্তু স্টিভ না থাকলে তাঁর যন্ত্রপাতি চার দেয়ালের বাইরে যেত না। স্টিভের ব্যবসায়িক বুদ্ধিতেই অ্যাপল কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করতে পেরেছে।

বড় বড় লোকেরা এতে বিনিয়োগ করলেন। বাইরে থেকে লোক এনে অ্যাপলের প্রেসিডেন্ট পদে বসানো হলো। আর স্টিভ চিন্তা করলেন এর সৌন্দর্যবর্ধন নিয়ে। তিনি সেকেলে ধাতব কেস ঝেড়ে ফেলে প্ল্যাস্টিকের কেস ব্যবহার করলেন। তাঁর রুচিবোধ আর ওজনিয়াকের মেধার সমন্বয়ে বিপ্লব ঘটে গেল পার্সোনাল কম্পিউটারের দুনিয়ায়। অ্যাপল টু’র বিক্রি গিয়ে দাঁড়ালো ১১ কোটি ৭০ ডলারে!

তখন অনেক বড় বড় কোম্পানি পাখির চোখ করেছে অ্যাপলের দিকে। বিনিয়োগ করতে চায় এই কোম্পানিতে। সে দৌঁড়ে আছে জেরক্স।

বিশ্বসেরা ফটোকপি প্রতিষ্ঠান:-জেরক্স

হ্যাঁ, এক নামেই যার পরিচয় এমন কিছু পণ্য বাজারে এসেছে যুগে। বাংলাদেশে একসময় গ্লোব বললেই মশার কয়েল বুঝত মানুষ, এখন যেমন মেরিল বললে পেট্টোলিয়াম জেলিকে বোঝে, সেকালে ফটোকপি বলতে মানুষ বুঝত জেরক্সকেই। কারণ জেরক্সের ফটোকপি মেশিন নাম করেছিল জগৎজুড়ে। তাই ফটোকপি না বলে লোকে বলত জেরক্স কপির কথা।

সেই জেরক্স তখন অনেক বড় কোম্পানি। তারাও পার্সোনাল কম্পিউটার তৈরি করেছে। আর বিপ্লবটা করেছে তাতে মাউস যোগ করে। কিন্তু এরচেয়েও আরেকটা বড় বিপ্লব ছিল। সেটাই বদলে দেয় কম্পিউটার উইন্ডোর ধারণাটা।

এর আগে কম্পিউটারের মনিটরে ফোল্ডার আর ডকুমেন্ট শো করত না। জেরক্সের ইঞ্জিনিয়ররা এমনকিছু সফটওয়ার বানালেন, সেগুলোর সাহায্যে ডিসপ্লেতে ফোল্ডার আর ডকুমেন্ট শো করানো যেত।

সেইসব ফোল্ডার কিংবা ডকুমেন্টে মাউস পয়েন্টার রেখে ক্লিক করলেই সেগুলো ওপেন করানো যেত। আরেকটা ব্যবস্থাও তাঁরা করেছিলেন, সেটাই স্টিভ জবসকে সবচেয়ে বেশি নাড়িয়ে দিয়েছিল। সেটা হলো কম্পিউটারে একসঙ্গে দুটো উইন্ডো খুলে দুটো আলাদা কাজ একইসঙ্গে করা যেত।

১৯৭৯ সাল। জেরক্স কোম্পানির কর্তারা চাইলেন অ্যাপলে কিছু টাকা বিনিয়োগ করতে। কিন্তু স্টিভ একটা শর্ত বেঁধে দিলেন। যদি জেরক্স তাঁদের সব প্রযুক্তি স্টিভকে দেখায় তবেই তিনি জেরক্সকে অ্যাপলে ১ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার সুযোগ দেবেন।

জেরক্সের কর্তরা রাজি হলেন। কিন্তু সেটা ছিল তাঁদের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত আর স্টিভ জবসের জীবনের সেরা সুযোগ। স্টিভ জেরক্সের কম্পিউটার দেখলেন, অবাক হয়ে গেলেন তাঁদের গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেস সিস্টেম দেখে, যে সিস্টেমে একই সঙ্গে একাধিক উইন্ডো খুলতে পারে।জবস শেষমেশ জেরক্সকে অ্যাপলে বিনিয়োগ করতে দেননি।

তার বদলে নিজেদের ইঞ্জিনিয়ারকে বলেছিলেন জেরক্সের মতো একাধিক উইন্ডোর একটা সিস্টেম তারা তৈরি করতে পারবে কিনা। হ্যাঁ, অ্যাপলের ইঞ্জিনিয়াররা সেটা পেরেছিল।

আরও উন্নত করেছিল গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেস সিস্টেম। অ্যাপলের পরবর্তী ভার্সনের কম্পিউটার একসাথে শুধু দুটি নয়, অনেকগুলো উইন্ডো খুলে কাজ করতে পারত। মাউসও অনেক আধুনিক করে তুলেছিলেন স্টিভ। অনেকগুলো বাটনের বদলে দুটি বাটনে নিয়ে এসেছিলেন মাউসকে।

ছয়

অ্যাপল টু-এর তখন মারকাটারি বাজার। বিল গেটসকেও সেই কম্পিউটার আকৃষ্ট করে। তিনি বাজার থেকে একটা অ্যাপল টু কিনে নিলেন। তারপর নাট-বল্টু খুলে চলল চুলচেরা বিশ্লেষণ। ভেতরের কারিগরী বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করলেন।

দেখলেন অ্যাপলে যতটা উন্নত ব্যক্তিগত কম্পিউটার হিসেবে, বাণিজ্যিক কম্পিউটার হিসেবে ততটাই নড়বড়ে। এতে কোনো বিজনেস সফটওয়ার নেই, তাই বড় বড় কোম্পানির ব্যাবসায়িক কর্মকাণ্ড চলবে না তাতে। তাই বিশাল একটা ক্রেতা গোষ্ঠির নাগালে পৌঁছুতে পারবে না অ্যাপল টু।

রীতিমতো উদ্বিগ্ন হলেন বিল গেটস, তারচেয়েও বেশি আশা দেখলেন। স্টিভ-ওজনিয়াকের এই যুগান্তকারী কম্পিউটারই হয়তো মাইক্রোসফটকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলবে! এরজন্য তৈরি করতে হবে একটা বিজনেস সফটওয়ার।

দীর্ঘদিন এটা নিয়ে ভাবলেন গেটস। তারপর তাঁর ইঞ্জিনিয়ারদের লেলিয়ে দিলেন অ্যাপল টু-এর জন্য একটা বিজনেস সফটওয়ার বানাতে। সফল হলেন, একটা সার্কিট বোডের ওপর চিপ বসিয়ে অ্যাপল টু-এর জন্য তৈরি হলো মাইক্রোসফটের বিজনেস সফটওয়ার।

সেটা তিনি নিয়ে গেলেন জবসকে দেখাতে। দেখামাত্রই সেটা মনে ধরল স্টিভের। রাজি হলেন অ্যাপলের জন্য মাইক্রোসফটের বিজনেস কার্ড ব্যবহার করতে।

এতে লাভ হলো দুই কোম্পানিরই। তরতর করে ওপরের দিকে উঠে গেল মাইক্রোসফটের বিক্রির পারদ। এক বছররের মধ্যে সেটা পরিণত হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় সফটওয়ার কোম্পানিতে।

১৯৮৩ সাল। তখন অ্যাপলের ব্যবসা বছরে ১ বিলিয়ন ডলারের। বিপরীতে মাইক্রোসফটের বিক্রি বছরে ৩২ মিলিয়ন ডলার মাত্র।

তখন স্টিভ জবস ম্যাকেন্টিস বা ম্যাক তৈরিতে হাত দিয়েছেন। স্টিভ জবস চাইছিলেন গেটস যেমন আল্টোয়ারের জন্য যেমন বেসিক নামে সফটওয়ার বানিয়েছিলেন, তেমন একটা প্রোগ্রামিক ল্যাঙ্গুয়েজ বানাক অ্যাপল টু-এর পরের প্রজন্মের কম্পিউটার ম্যাকিন্টসের জন্যও। তাতে রাজি হলেন গেটস। তাঁদের মধ্যে তিনটি সফটওয়ারের জন্য চুক্তি হলো। বেসিকের মতো একটা সফটওয়ার, ওয়ার্ড এবং এক্সেল।

স্টিভ হিসাব করে দেখলেন, যদি তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আইবিএম এক্সেলের কোনো ভার্সন বাজারে না ছাড়তে পারে তাহলে তাদের পক্ষে সম্ভব নয়, ম্যাকিন্টাসের সাথে প্রতিযোগিতা করা। জবসের সঙ্গে গেটসের চুক্তি ছিল প্রতিটা ম্যাকিন্টস বিক্রি হলে প্রতিটা অ্যাপ্লিকেশনের জন্য গেটস পাবে ১০ ডলার করে। কিন্তু এটা গেটসের জন্য লাভজনক ছিল না।

স্বাভাবিকভাবেই গেটসের মুখ ভার ছিল। ব্যাপারটা চোখে পড়েছিল স্টিভের। তিনি গেটসকে অনুমতি দিলেন শুধু অ্যাপলের জন্য আলাদা করে সফট তৈরি করে বাজারে বিক্রি করার জন্য। কিন্তু বিল গেটসের মাথায় তখন অন্য চিন্তা ঘুরছে।

ম্যাকিন্টাসের অগ্রগতির যে হার বাজারে আসতে অনেক সময় লেগে যাবে। আর ম্যাকিন্টস বাজারে না আসা পর্যন্ত মাইক্রোসফটেরও বাজার চাঙ্গা হবার উপায় নেই। সতুরাং শুধু অ্যাপলের কথা ভাবলেই চলবে না, বাজারের যে কোনো কম্পিউটারের জন্য সফটওয়ার বানাতে হবে।

সেই মুহূর্তে বাজারে অ্যাপলের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বী আইবিএম। তারাও আধুনিক পিসি বানাতে। এজন্য তাঁরা বিল গেটসের শরণ নিলেন। গেটস ভুলে গেলেন স্টিভের সঙ্গে চুক্তির কথা। নতুন করে চুক্তি করতে সম্মত হলেন আইবিএমের সঙ্গে।

একসময়ের দুনিয়া কাঁপানো প্রতিষ্ঠান-আইবিএম

কিন্তু এজন্যও একটা শর্ত জুড়ে দিলেন। মাইক্রোসফটের তৈরি কোনো সফটওয়ারেই আইবিএম-এর একছত্র আধিপত্য থাকবে না। মাইক্রোসফটের অধিকার থাকবে যেকোনো সফটওয়ার আলাদাভাবে বাজারে বিক্রি করার। অনেক দেনদরবার করে শেষ পর্যন্ত রাজি হয় আইবিএম।

আর সেটাই বিশ্ব প্রযুক্তির ইতিহাসের মোড় আরেকবার ঘুরিয়ে দেয়। এই চুক্তিতে মাইক্রোসফট লাভবান হয়েছে, বলা হচ্ছে, এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসায়িক চুক্তি।

এই চুক্তিই পরে বিল গেটসকে ফুঁলিয়ে-ফাপিয়ে তুলেছিল। আইবিএমও অ্যাপলকে হটিয়ে আবার নিজেদের সিংহাসন পুনরুদ্ধার করে কম্পিউটার জগতে। ধস নামে অ্যাপলের ব্যবসায়। প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাবার যোগাড় হয় কোম্পানিটি।

এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ বিল গেটস। জেরক্সের কাছ থেকে অ্যাপল যে গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেস সিস্টেমের ডিজাইন চুরি করে আরও উন্নত করেছিল, সেই সফটওয়ারটাই বিল গেটস চুরি করে বেঁচে দিয়েছিলেন আইবিএমএর কাছে। শুধু আইবিএম নয়, মাইক্রোসফট বাজারে যে অপারেটিং সিস্টেম বাজারে ছাড়ে, তাতেও ছিল ওই গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেস সিস্টেম।

সাত

অ্যাপল যখন পথে বসার জোগাড়, তখন কোম্পানিটির প্রেসিডেন্ট আর পরিচালকরা একমত হন, বিল গেটসই অ্যাপলকে ডুবিয়েছে আর এর জন্য স্টিভ জবসই দায়ী। তাই জবসকে বহিষ্কার করা হয় নিজের হাতে গড়া কোম্পানি থেকে।

তারপর অ্যাপল চেষ্টা করে স্টিভকে বাদ দিয়েই ব্যবসা করতে। প্রযুক্তি জগতে মাইক্রোসফটকে প্রধান শত্রু হিসেবে গণ্য করে। কিন্তু তাতেও ভাগ্য বদলায়নি অ্যাপলের। দিনে দিনে দেউলেপনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় কোম্পানিটি। অন্যদিকে মাইক্রোসফটে চলছে তখন বসন্তের সুবাতাস। কোম্পানিটি ধীরে ধীরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কম্পিউটার কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে।

একসময় বিল গেটস বনে যান বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে। কিন্তু আইন এসে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় মাইক্রোসফটের দুর্বার গতিতে। একটা কোম্পানি একচেটিয়া ব্যবসা করা আইনবিরুদ্ধ। নানাভাবে কোনঠাসা করে ফেলা হয় গেটসকে। তাঁকে তদন্তাধীন রাখা হয় দীর্ঘদিন।

এই ক্রান্তিলগ্নে অ্যাপল আবার স্টিভ জবসকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। অ্যাপলে আবার যোগ দিয়ে স্টিভ প্রথমেই যোগাযোগ করেন শত্রু বিল গেটসের সঙ্গে। তিনি বোঝাতে সক্ষম হন বিল গেটস অপ্রতিদ্বন্দ্বী, এজন্যই তাঁকে আইনের নজরদারিতে থাকতে হচ্ছে।

এখন তাঁরও একজন প্রতিদ্বন্দ্বী দরকার, অন্যদিকে অ্যাপলের দরকার একজন বিনিয়োগকারী। বিল গেটস অ্যাপলে ১৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করলেন। শুরু হলো অ্যাপলের নতন পথচলা।

তারপরের ইতিহাস দুই কোম্পানির জন্যই সাফল্যে মোড়া। অ্যাপল আইপড বাজারে নিয়ে এসেছ। আইফোন এনে পুরো কম্পিউটার সিস্টেমটাই ঢুকিয়ে দিয়েছেন মুঠোফোনে।

২০১২ সালে স্টিভ জবসের অকাল প্রয়ানের আগ পর্যন্ত স্টিভ অ্যাপলেন হাল ধরে রেখেছিলেন শক্ত করে। অন্যদিকে বিল গেটস এখনও মাইক্রোসফটের কর্ণধার হয়ে আছেন, এখনো মাইক্রোসফট বিশ্বের সবচেয়ে বড় সফটওয়ার প্রতিষ্ঠান।।

সূত্র: স্টিভ জবস/ওয়াল্টার আইজ্যাকসন ও বিল গেটস/ জ্যানেট লো এবং জিনিয়াস সিরিজ/ন্যাশনাল জিওগ্রাফি/আব্দুর গাফফার রনি/বিজ্ঞান চিন্তা/প্রথম আলো-২০১৭