ফেসবুকে কোনো লেখায় কমেন্ট করার নিয়ম

প্রথমে যে-লেখার নিচে কমেন্ট করবেন সেটি ভালো করে পড়ে নিন। কোনো শব্দ ও যতিচিহ্ন বাদ দেয়া যাবে না। কোনো বাক্য বুঝতে অসুবিধা হলে তা পুনরায় পড়ুন। তারপরও বুঝতে অসুবিধা হলে, একটি ছোট কমেন্ট করে পোস্টদাতাকে জানান যে আপনি অমুক বাক্যটি বুঝতে পারছেন না। কোনো শব্দ বুঝতে অসুবিধা হলেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করুন।

লেখাটি পড়া শেষ হলে ১ মিনিট এর বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবুন। লেখক কী বলতে চেয়েছেন তা বুঝার চেষ্টা করুন। খেয়াল রাখতে হবে, আপনি যেন শুধু লেখার বিষয়বস্তু নিয়েই ভাবেন, লেখকের বিষয়বস্তু নিয়ে নয়। লেখকের চরিত্র, পেশা, পোশাক, ধর্ম, অধর্ম, ব্যক্তিগত বিশ্বাস, রাজনীতিক পরিচয়, আর্থিক অবস্থা, সামাজিক মর্যাদা, রূপ, খ্যাতি, ইত্যাদি আমলে নেয়া যাবে না। লেখক তার লেখায় কী বলেছেন, শুধু এটুকোই আমলে নিতে হবে।

যদি টের পান যে লেখাটির বিষয়বস্তু আপনি বুঝে উঠতে পারছেন না, তাহলে এর পেছনের কারণগুলো অনুসন্ধান করুন। লেখকের সাথে আপনার পড়াশোনা, অভিজ্ঞতা, ও দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য, ব্যক্তিগত শত্রুতা, হিংসা-বিদ্বেষ, বিশ্বাস-ভিত্তিক দ্বন্দ্ব, ইত্যাদি এ ক্ষেত্রে সাধারণ কারণ হতে পারে। কারণটি খুঁজে পেলে, তা সমাধান করার উদ্যোগ নিন। উদ্যোগ সফল হলে লেখাটি আবার পড়ুন, এবং উপরের ধাপগুলো পুনরায় অনুসরণ করুন।

যদি দেখা যায় যে লেখাটি পড়ে আপনি এর বিষয়বস্তু বুঝতে পেরেছেন, তাহলে নিজেকে সৎভাবে জিগ্যেস করুন— আমি কি সত্যি সত্যিই লেখাটির সারকথা বুঝতে পেরেছি? না কি বুঝতে পারার অভিনয় করছি?

যদি মনে হয় বুঝতে পারেন নি, কিন্তু নিজের ভেতরের জেদ বা অহংকারকে তুষ্ট করার জন্য অভিনয় করছেন বুঝে ফেলার, তাহলে উপায় খুঁজুন কীভাবে জেদ এবং অহংকারকে খুন করা যায়। খুনে সফল হলে লেখাটি আবার পড়ুন, এবং উপরের ধাপগুলো অনুসরণ করুন।

কিন্তু যদি মনে হয় যে লেখাটি আপনি সত্যি সত্যি বুঝতে পেরেছেন, তাহলে কল্পনা করুন— লেখাটি অন্য কেউ পড়লেও আপনার মতোই বুঝবে কি না। না কি অন্য কেউ পড়লে এটিকে ভিন্নভাবে বুঝবে। এক্ষেত্রে লেখাটির প্রাসঙ্গিকতা বিচার করতে হবে, এবং সে-অনুযায়ী লেখাটির অর্থ উদ্ধ্বার করতে হবে। যদি মনে হয় আপনি লেখাটি কী প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে তা বুঝতে পারেন নি, তাহলে প্রসঙ্গটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন, অথবা একটি ছোট কমেন্ট করে লেখকে জানান যে আপনি লেখাটির প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে পারছেন না।

উপরের সব ধাপ অনুসরণ করার পর যদি দেখেন আপনি লেখাটির সারমর্ম অনুধাবন করতে পেরেছেন, তাহলে ধরে নেয়া যায়— আপনি কমেন্ট করার জন্য প্রস্তুত।

এবার স্থির করুন, লেখাটির বিষয়ে আপনার কোনো বক্তব্য আছে কি না। থাকলে নিজেকে জিগ্যেস করুন, বক্তব্যটি কমেন্ট আকারে প্রকাশ করা কেন জরুরী। বক্তব্যটির চরিত্রও বিশ্লেষণ করুন। দেখুন এটি কেবলই কোনো রাগ-বিরাগ বা আবেগের ফসল কি না। লেখাটির বিষয়বস্তুর সাথে এটি যায় কি না। এক্ষেত্রে কোনো কমেন্টের বক্তব্যকে আমি তিন ভাগে ভাগ করতে চাই।

এক— সাধারণ অনুভূতির প্রকাশ। যেমন, লেখাটির প্রশংসা করা বা নিন্দা জানানো।

প্রশংসা করার সময় খেয়াল রাখতে হবে, আপনি যেন নিজের ব্যক্তিত্বকে ধূলোয় না মেশান। অপ্রয়োজনীয় প্রশংসা করার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। নিজেকে জিগ্যেস করুন, আপনি কী উদ্দেশ্য প্রশংসা করছেন। লেখককে বা কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠির মানুষকে খুশি করতে প্রশংসা করছেন কি না। প্রশংসার পেছনে কোনো ব্যক্তিগত লাভ বা প্রাপ্তি জড়িত আছে কি না। এরকমটি হলে প্রশংসা না করাই ভালো। কারণ এ ধরণের প্রশংসা, প্রশংসাকারী এবং প্রশংসিত ব্যক্তি, দুজনকেই নষ্ট করে। প্রশংসা করতে হবে সৎভাবে, আবেগমুক্ত হয়ে। কারও নাম বা ছবি দেখেই ধুম করে প্রশংসাসূচক বাক্য লিখা যাবে না। প্রশংসার পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ আছে কি না তা তলিয়ে দেখতে হবে। কারণ অযৌক্তিক প্রশংসা হলো ঘুমের বড়ি। এ প্রশংসা শুনে কেউ অনুপ্রাণিত হয় না, উল্টো ভেতরে ভেতরে লাশ হতে শুরু করে।

নিন্দা করার সময় নিন্দার কারণ উল্লেখ করতে হবে। এ কারণ যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তাহলে নিন্দাটিও পক্ষপাতদুষ্ট হবে। কোনো ব্যক্তি, দেশ, মতাদর্শ, ধর্ম, অধর্ম, পেশা, জাতি, সম্প্রদায়, ইত্যাদির পক্ষ নিয়ে নিন্দা না করাই ভালো। কারণ এ নিন্দা সমাজ ও সভ্যতার কোনো উপকারে আসে না। নিন্দা করতে হবে ব্যক্তিগত উপলব্দি থেকে, এবং মগজ খাটিয়ে। ‘লেখাটি ফালতু হয়েছে’, বা ‘আপনাকে আগে জ্ঞানী ভাবতাম’ এ ধরণের নিন্দায় মগজের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। লেখাটি কী কারণে ফালতু হয়েছে, বা কাউকে আপনি কী কী কারণে আগে জ্ঞানী ভাবতেন, কিন্তু এখন ভাবেন না, তা ধৈর্য্যসহকারে বলা উচিত। কোনো অবস্থাতেই মাথা গরম করা যাবে না। মাথা গরম করলেই কাঁঠাল পেকে যাবে। পাকা কাঁঠালের উপর বসে সহনশীল আচরণ করা সম্ভব নয়। গালি দেয়ার সময় ভেবেচিন্তে দিতে হবে। গালি না দিলে আপনার কোনো ক্ষতি হবে কি না, তা ভেবে দেখতে হবে। যদি দেখা যায় যে গালাগাল করে কোনো নগদ ও অনগদ প্রাপ্তি মিলবে না, তাহলে তা পরিহার করাই উত্তম। যিনি গালি দেন, তার মাথায় গালির একটি প্রতিক্রিয়া দীর্ঘক্ষণ ধরে বিরাজ করে, যা গালিদাতার মানসিক শান্তিকে নষ্ট করে। এজন্য নিজের স্বার্থেই গালাগাল থেকে বিরত থাকা উচিত। গালির আশ্রয় না নিয়েও, সুন্দর ও শিল্পসম্মতভাবে কোনো লেখা বা লেখকের নিন্দা করা যায়। প্রশ্ন উঠতে পারে গালি কী? কীভাবে বুঝবো কোনো শব্দ গালি কি না? গালি হলো এমন এমন শব্দ, যা অন্যকেউ আপনাকে বললে আপনি রাগ করেন।

দুই— নিজস্ব মতের প্রকাশ। যেমন, লেখাটির সাথে আপনি কী কী কারণে সহমত বা দ্বিমত পোষণ করছেন, তা লেখককে জানানো।

এক্ষেত্রে শুধু ‘সহমত’ লেখা উচিত নয়। এ অভ্যাস আপনাকে ক্লীবে পরিণত করতে পারে। কারণ এতে মস্তিষ্কের কোনো পরিশ্রম হয় না। মতামত প্রকাশ করার সময় তা এমনভাবে লিখতে হবে, যেন মস্তিষ্ক সামান্য হলেও ঘামে। আয়েশি ভঙ্গীতে ‘সহমত ভাই’, ‘সহমত স্যার’, ‘সহমত লিডার’, এগুলো লিখা কোনো কাজের কথা নয়। বরং এতে সন্দেহ জাগতে পারে, আপনি কারও দাস কি না। সহমত প্রকাশ করার সময় লেখটির গুরত্বপূর্ণ দিক নিয়ে দুয়েক কথা বলতে হবে। এতে অন্যদের বুঝতে সুবিধা হয়, লেখাটি পাঠ করা কেন জরুরি।

দ্বিমত প্রকাশ করার সময় আপনার মতামতকে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করুন। এ মতামতের ভিত্তি কী, তাও উল্লেখ করুন। ব্যক্তিগত রাগ-বিরাগ, আবেগ, ক্রোধ, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, কুসংস্কার, মতাদর্শ, কাল্পনিক রটনা, ভূতের গল্প, ইত্যাদিকে ভিত্তি হিশেবে ধরে দ্বিমত পোষণ করা উচিত নয়। কারণ এগুলোকে ভিত্তি হিশেবে ধরলে, আপনার দ্বিমতের সাথে লেখক দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ পাবেন না, যদি না লেখকের লেখাটিও আপনার ধাঁচের হয়। লেখককে আপনার দ্বিমত গ্রহণ করতে চাপাচাপিও করা যাবে না। আপনার দ্বিমতকে গ্রহণ অথবা বাতিল করার স্বাধীনতা লেখককে দিতে হবে। যদি এ স্বাধীনতা দিতে না চান, তাহলে দ্বিমত প্রকাশ করা উচিত নয়।

দ্বিমত প্রকাশ করার আগে ভেবে দেখতে হবে আপনি গোঁড়া কি না। গোঁড়া হলো তারা, যারা নিজেদের মতটিকেই সর্বশেষ মত ভাবে। আমার কথাই শেষ কথা, আমার ধারণাই শ্রেষ্ঠ ধারণা, আমার কথাই পরম সত্য, তর্কে আমি কখনো হারবো না, এরকমটি ভাবাই গোঁড়ামি। এ বিষয়ে আলাদা প্রবন্ধে বিস্তারিত লিখেছি, তাই এখানে আর উল্লেখ করছি না। যদি আপনি গোঁড়া হন, তাহলে কোনো বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলেও তা প্রকাশ করা উচিত নয়। কারণ, এ ধরণের দ্বিমত হলো তালগাছ আঁকরে ধরে রাখার দ্বিমত। এগুলো হলো পক্ষাপাতদুষ্ট অচিন্তিত প্রোপাগান্ডা। মাতামতের স্বাধীন প্রবাহে এগুলো বাধা সৃষ্টি করে।

দ্বিমতটি যখন লিখবেন, তখন খেয়াল রাখতে হবে আপনি যেন কোনো ভূতের আছরগ্রস্ত না হন। এ ভূত নিজের ভেতর থেকে সৃষ্টি হতে পারে, আবার আপনি যে-সমাজে বাস করেন, সে-সমাজ থেকেও তৈরি হতে পারে। ভূতের আছরমুক্ত হয়ে, সৎ ও স্বাধীনভাবে পোষণ করতে হবে দ্বিমত। কোনো কিছুকে রক্ষা বা ধ্বংস করার মতলব থেকে দ্বিমত পোষণ করা ঠিক নয়। স্বার্থপর দ্বিমত আর বিশুদ্ধ দ্বিমতের পার্থক্যটি বুঝতে হবে।

তিন— অপ্রাসঙ্গিক ফালতু কথা ও স্টিকার।

ফালতু কথা হলো এমন কথা, যার কোনো সারবত্তা নেই। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথাও ফালতু কথায় পরিণত হতে পারে, যদি তা প্রাসঙ্গিকভাবে উত্থাপিত না হয়। মনে করুন কোথাও গরুর খামার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ওখানে গিয়ে আপনি ইরাক যুদ্ধের চিলকোট রিপোর্ট নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। চিলকোট রিপোর্ট নিয়ে কথা বলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু অপ্রাসঙ্গিকভাবে তা গরুর খামারের আলোচনায় উত্থাপিত হলে এটি ফালতু কথায় পর্যবসিত হবে।

একটি ফালতু কথা, মন্তব্যকারীর ব্যক্তিত্ব এবং জানাশোনার পরিধিকেও তুলে ধরে। এটি মন্তব্যকারীর জন্য লাভজনক বলে মনে করি না। অনেক সময় কাউকে বিরক্ত করার উদ্দেশ্যেও ফালতু কথা বলা হয়, যা কাম্য নয়।

স্টিকার কমেন্টও এড়িয়ে চলতে হবে। কেবল বিনোদনমূলক ভিডিও, কৌতুক, পারিবারিক ও ঘনিষ্ঠজনের ছবি, আড্ডামূলক লেখা, এগুলোর নিচে স্টিকার কমেন্ট করা যেতে পারে।

এবার আপনার বক্তব্য কমেন্ট আকারে প্রকাশ করুন।

—মহিউদ্দিন মোহাম্মদ