ওয়ান মোর ফিচার ট্র্যাপ – বিগেস্ট স্টার্টআপ কিলার

১)

ইউনিভার্সিটি লাইফে একবার আমাদের হোস্টেল এ গ্রাম থেকে একজন পাচক নিয়ে আসা হলো। মুশকিল হলো, তিনি যে তরকারি-ই রাঁধেন, পানসে লাগে।

তো, তিনি কোন রান্নাটা ভাল পারেন, সেটা বের করার জন্য অজস্র ধরণের তরকারি রান্নার চেষ্টা করানো হল তাঁকে দিয়ে। আমরা সকালে বাজার করে দিয়ে ক্লাসে চলে যেতাম, দুপুরে আসে খেতে বসতাম। এভাবে মাসখানেক চলে গেল, কিন্তু তাঁর রান্না পানসেই রয়ে গেল। কেউ খেতে পারেনা।

শেষে কোনভাবেই সমাধান না আসায় একদিন সিদ্ধান্ত হল, আচ্ছা তাহলে দেখা যাক উনি কিভাবে রান্না করেন। তো, সেটি করতে গিয়েই বের হয়ে আসলো মূল সমস্যা। সেটি কি?

সেটি হচ্ছে, তিনি যে তরকারিই রান্না করেন না কেন, শুরুতে তেল মসলা দিয়ে তিনি সেগুলো কষিয়ে নেন না। বরঞ্চ সব কিছু এক সাথে কেটে পানিতে আগে সেগুলো ছেড়ে দিয়ে সিদ্ধ করেন। এরপর সেটিতে তেল, মসলা ছেড়ে দিয়ে রান্না করেন। ফলে, সব কিছুই পানসে হয়ে যায়।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই সমস্যাটা সমাধান করতে আমরা এত সময় কেন নিয়েছিলাম?

কারণ, আমরা “ওয়ান মোর ফিচার” ট্র্যাপ এ পড়েছিলাম।

২)

“ওয়ান মোর ফিচার ট্র্যাপ” হচ্ছে, যখন কোন একটা সমস্যা সমাধান করার জন্য সেই সমস্যার গোড়ায় না গিয়ে অন্য কিছু করার চেষ্টা করা হয়, এবং আশা করা হয় সেটি কাজ করবে।

মুশকিল হচ্ছে, ৯৯% ক্ষেত্রেই অন্য যে কাজটি করার চেষ্টা করা হয়, সেটিও কাজ করেনা। এই সমস্যা আরও জটিল ধারণ করে যখন সেটিও সমাধান করার চেষ্টা না করে একের পর এক নতুন জিনিস করার চেষ্টা করা হয়, এবং ৯৯% ক্ষেত্রেই সব গুলোই ব্যর্থ হয়।

আমাদের পাচকের ক্ষেত্রে “রান্না পানসে কেন হয়েছে”, সেটি বের করার জন্য আমরা যদি পরের দিনই তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে রান্না কিভাবে করা হচ্ছে সেটি দেখতাম, তাহলে এই “ওয়ান মোর ফিচার” ট্র্যাপ থেকে বের হয়ে আসতে পারতাম।

৩)

“ওয়ান মোর ফিচার” ট্র্যাপ এ আমরা কেন পড়ি?

মানুষের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে কোন সমস্যায় পড়ে গেলে সেটি সমাধান করার চেষ্টা না করে এভয়েড করার চেষ্টা করা। এটা সম্ভবত এক ধরণের ভীতি থেকে আসে। কারণ, বেশির ভাগ মানুষের কাছে কোন একটা সমস্যা জটিল আকার ধারণ করলে সেটির সমাধান করাটা সহজ মনে হয়না, বরঞ্চ, মনে হয় আমি বরঞ্চ অন্য কিছু একটা করি, সেটি মনে হয় সহজ হবে।সেই ভাবনা থেকেই আমরা ওয়ান মোর ফিচার ট্র্যাপ এ পড়ে যাই।

ব্যক্তিগত জীবনে আমাদের অনেকেই এক যায়গায় স্থির থাকতে পারিনা। আজ এটা করছি তো কাল ওটা। এভাবে এটা ওটা করতে গিয়ে কোন কিছুতেই আমাদের সত্যিকারের মনযোগ দেয়া হয়ে উঠেনা। ফলে, কোন একটা কিছুতে বেস্ট হওয়া – এরকমটা খুব কম হয় আমাদের মাঝে (Jack of all trades, but master of none). এ কারণে কাঙ্ক্ষিত সাফল্যও ধরা দেয় খুব কম মানুষের জীবনে।

স্টার্টআপ বিজনেস এর ক্ষেত্রেও এই “ওয়ান মোর ফিচার ট্র্যাপ” একটা ভয়াবহ সমস্যা।

৪)

ইভ্যালির অবস্থা আমরা প্রায় সবাই জানি এখন। ১০ জন এর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ২/৩ জনকে ডেলিভারি দিয়ে বাকিদের দীর্ঘকাল ধরে ঘুরানোর স্ট্র্যাটেজির মাধ্যমে ইভ্যালি বিশাল গ্রো করেছিল খুব অল্প সময়ের জন্য, আবার একই কারণে খুব দ্রুতই পতনের মুখে পড়েছে এই বিজনেসটি।

তো, ইভ্যালির এই পতন কিন্তু হঠাৎ করেই হয়নি। ওদের বিজনেস মডেল নিয়ে সমালোচনা আজ থেকে হচ্ছিলনা, সেটি হচ্ছিল প্রায় শুরু থেকেই।

এই কোম্পানির সিইও’র পার্সোনাল কোন ফেসবুক পোস্ট এও হাজার হাজার মানুষের ডেলিভারি না পাওয়ার আহাজারিতে ভরে থাকতো কমেন্ট সেকশন। পত্রপত্রিকার রিপোর্ট তো ছিলই। সেগুলো দেখে স্পষ্টই বুঝা যেতো যে, বড় ধরণের কোন গড়মিল রয়েছে এই বিজনেস এর গোড়ায়, এবং, যেকোন সময় বড় কোন সমস্যা ঘটে যেতে পারে।

কিন্তু, কেন যেন ইভ্যালির কর্তাব্যক্তিরা মূল সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেননি। বরঞ্চ, ওনারা ইফুড, ইখাতা, ইহেলথ, ইবাজার, ইজবস ইত্যাদি নামে আরও ১০/১২ টি নতুন বিজনেস খুলে বসেছিলেন, এবং সেজন্য বিশাল টিমও হায়ার করে ফেলেছিলেন। এমনকি ওনারা বাইরের অন্য বিজনেস ও কেনা শুরু করে দিয়েছিলেন (ফ্লাইট এক্সপার্ট)। শুধু তা-ই নয়, অন্যান্য স্টার্টাপ এ ইনভেস্টমেন্ট এর ঘোষণাও ওনারা দিয়ে ফেলেছিলেন।

এর পেছনে যে সাইকোজি কাজ করেছে, সেটি হচ্ছে, ওনাদের মূল বিজনেস মডেল ঠিক করার দরকার নেই, বরঞ্চ ওনারা হেলথ, জবস, টিকিট, সেকেন্ডহ্যান্ড মার্কেটপ্লেস থেকে শুরু করে সব কিছুতেই বিশাল বিশাল বিজনেস দ্রুত বিল্ড করবেন, সাফল্য না এসে যাবে কোথায়!

এর ফলে যেটা হয়েছে, অনেক কিছু তারা করতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু, মূল সমস্যাটা তারা সময়মতো সমাধান করার চেষ্টা করেননি, কিংবা করতে পারেননি। ফলে, যা হবার তাই হয়েছে। “ওয়ান মোর ফিচার ট্র্যাপ” এ পড়ে আজ নিশ্চিত পতনের মুখে পড়েছে একসময় বিশাল চমক দেখানো এই ইকমার্স বিজনেসটি।

(এই পোস্ট এর ছবি দ্রষ্টব্য। ইভ্যালির কর্তাব্যক্তিরা গর্বভরে এই ছবিটা যতবারই পোস্ট করতেন, ততবার আমার মাথায় “ওয়ান মোর ফিচার ট্র্যাপ” আওয়াজ দিতো)

৫)

আমি ইভ্যালির উদাহরণ না দিয়ে কিন্তু অন্যান্য আরও স্টার্টআপ এর উদাহরণও দিতে পারতাম। উদাহরণ আমাদের আশেপাশেই রয়েছে।

আপনারা একটু ভাবলেই দেখতে পাবেন, ফোকাস যেন না হারায়, সেজন্য বাংলাদেশে উবার বন্ধ করে দিয়েছে “উবার ইটস”, মনযোগ দিয়েছে রাইড শেয়ারিং এর মার্কেটটা এখানে ক্লিয়ারলি উইন করার জন্য। ৬ বছর হয়ে গেছে, চাইলেই তারা ৬ টা সার্ভিস দেবার চেষ্টা করতে পারতো। অথচ স্রেফ একটা সার্ভিসই এখানে দিয়ে যাচ্ছে উবার। রাইডস।

কিন্তু অপরদিকে উবারের কমপিটিটিটর লোকাল স্টার্টআপ গুলো (আমি ইচ্ছে করেই কোন নাম নিলাম না) তাদের মূল বিজনেসটাকে আরও ভালভাবে করার চেষ্টার বদলে একের পর এক অজস্র নতুন নতুন সার্ভিস নিয়ে এসেছে, কিন্তু তাঁদের এক্সপেকটেশন অনুযায়ী কোনটাই সেভাবে সম্ভবত ক্লিক করেনি মার্কেট এ, যতটুকু করার কথা ছিল। ফলে কোন একটা সেগমেন্ট এ এখন পর্যন্ত ক্লিয়ার উইনার হতে পারেনি তাদের কেউ। ফলে ফলো অন ফান্ডিং যেমন তাদের দেখা যায়নি, তেমনি দেখা যায়নি সেই গ্রোথ, যেটি পাওয়ার কথা ছিল তাদের।

এটাও “ওয়ান মোর ফিচার ট্র্যাপ” এর আরেকটি বড় উদাহরণ।

৬)

আমি নিজে একজন স্টার্টআপ ফাউন্ডার হবার কারণে এই ট্র্যাপ হাড়ে হাড়ে টের পাই।

যে মার্কেট সেগমেন্ট টায় (অটোমোটিভ) আমরা কাজ করি, সেটি সম্ভবত দেশের সবচাইতে জটিল একটা সেগমেন্ট। এখানে গাড়ির মালিক, ড্রাইভার, টেকনিশিয়ান, গ্যারেজ মালিক, পার্টস সাপ্লায়ার সহ অজস্র স্টেকহোল্ডার আছেন, এই ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের প্রত্যেকের ইনপুট/আউটপুট ও এক্সপেকটেশন সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফলে এখানে সমস্যার জটিলতার অন্ত নেই।

চ্যালেঞ্জ এর জটিলতা দেখে আমাদের প্রায়ই অধৈর্য লাগে, ইচ্ছে করে, ধুর, বরঞ্চ এটা করি, ওটা করি। অন্যরা করেছে, সফল হয়েছে। আমরাও নিশ্চয়ই হবো। কিন্তু এই “ওয়ান মোর ফিচার ট্র্যাপ” এ পড়ার ভয়ে সেটি থেকে বিরত থাকি। ট্রাস্ট মি, এই লোভ সম্বরণ করা ভীষণ কঠিন। আমি হাড়ে হাড়ে জানি।

গুড নিউজ হচ্ছে, এই ট্র্যাপ এ না পড়ার চেষ্টার সুফল আমাদের এখন আসতে শুরু করেছে। সেটা নিয়ে হয়তো লিখবো আরেক দিন।

৭)

এই বিষয়টা নিয়ে আমি অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম লিখবো। লিখবো লিখবো করেই লিখা হয়নি। অনেকে আবার মন খারাপ করতে পারেন কেন এটা নিয়ে লিখলাম, সেটি নিয়ে দ্বিধা করাটাও একটা কারণ (কেউ মন খারাপ করলে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি)। কিন্তু অজস্র স্টার্টআপকে একই ফাঁদে পড়তে দেখে মনে হলো লিখেই ফেলি।

তবে এই লেখাটা কেন লিখলাম সেটির মূল কারণ আসলে এটা না। মূল কারণ হচ্ছে একটা সিক্রেট। আচ্ছা, সেটা বলেই ফেলি।

এই লেখাটা আমি আসলে লিখেছি নিজের জন্য। আমি নিজে যেন ওয়ান মোর ফিচার ট্র্যাপ এ না পড়ে যাই।

হ্যাপি স্টার্টআপ!

শুভ আল ফারুক
CEO
যান্ত্রিক