এই ছবিটার গল্প জেনে নিই

২০০৭ সালের একটা মুভি আছে। মুভির নাম Charlie Wilson’s War . কাস্টিং ও খুব ভারী ছিলো। Charlie Wilson এর ক্যারাক্টারটা করছে Tom Hanks. সাপোর্টিং একটা রোলে ছিলো জুলিয়া রবার্ট। সিনেমার কাহিনী /স্ক্রিপ্টে ছিলো Aaron Sorkin. এই ভদ্রলোক আমার ফেভারিট মিডিয়া পার্সোনালিটিদের মাঝে একজন।

পুরা সিনেমার কাহিনী গড়ে উঠছে Charlie Wilson নামের এক কংগ্রেসম্যানকে কেন্দ্র করে। ভদ্রলোক পার্টিবাজ মানুষ। পার্টি করে বেড়ান। তো এর মাঝে এক বান্ধবীর মাধ্যমে তিনি আফগানদের ব্যাপারে জানতে পারেন। বান্ধবী তাকে কনভিন্স করে পাকিস্তান যাবার জন্য। সেইখানে তিনি পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের সাথে দেখা করেন।

পাকিস্তানিরা তাকে নানা ভাবে কনভিন্স করার চেষ্টা করে…আফগানিস্তানে আমেরিকার আরো সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকা উচিত। এক পর্যায়ে তাকে একটা রিফিউজি কক্সাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।

চার্লি পুরা ব্যাপারটা বুঝতে পারে। সে আমেরিকান সরকারকে আফগানিস্তানে আরো সক্রিয় ভাবে অংশ নিতে চাপ দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্ত পাকিস্তানের CIA অপারেটিভরা এটাতে আগ্রহী ছিলো না।

এর পরের কাহিনী চার্লির সংগ্রামের। সে কিভাবে নানা কল কাঠি নেড়ে আফগান মুজাহেদিনদের হাতে অস্র তুলে দিছে তার ইতিহাস।

আফগান যুদ্ধের মোড় ঘুরানো কয়েকটা ইস্যুর একটা হচ্ছে স্ট্রিংগার মিসাইল। রাশিয়ান হেলিকপ্টারের সামনে মুজাহেদিনরা পিঁপড়ার মতো মারা পরছিলো। সেই অবস্থার মোড় ঘুরিয়ে দেয় স্ট্রিংগার মিসাইল।

এটা খুব সম্ভবত “অপারেশন সাইক্লোন” নামে পরিচিত ছিলো। এই অপারেশনে মুজাহেদিন দের অস্র সরবরাহের কাজে জড়িত ছিলো পাকিস্তান, মিসর এবং ইজরায়েল।

আফগানিস্তানে রাশিয়ানদের পরাজয়ের পর চার্লি আফগানিস্তান পুনর্গঠনে আমেরিকার সম্পৃক্ততা চেয়ে চেয়েছিলো। কিন্ত আমেরিকা সে ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি।

আমেরিকার এজেন্ডা ছিলো সোভিয়েত দের হারানো। তারা হারছে। শেষ। এরপর আফগানিস্তানের কি হবে..এটা তাদের কাছে কোন ইস্যু না।

যার ফলে আফগানিস্তানে একাধিক “ওয়ার লর্ড” এর উদ্ভব ঘটে। গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।

এরই ফাঁকে তালে বান রা ক্ষমতা দখল করে নেয়।

অনেকে অভিযোগ করেন তালে বান দের উত্থানে পাকিস্তানের ISI এর ভূমিকা ছিলো। তালে বানরা ক্ষমতা দখলের পর কোন এক নেতা নাকি মিডিয়াতে গর্ব করে বলেছিলেন- ” এই প্রথম আফগানিস্তানে প্রো-পাকিস্তানি সরকার এসেছে।

___________

১৯৭৫ সাল । ভিয়েত কং গেরিলারা চারদিক থেকে তাদের বৃত্ত ছোট করে আনছে । সাইগুনে আমেরিকান এ্যাম্বেসিতে অবস্থানরত সব নাগরিক কে যে কোন মূল্যে সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে হেলিকপ্টার গুলো ইউএস এম্বেসির কম্পাউন্ডে অবস্থানরত যাত্রীদের সরিয়ে নিতে থাকে। একই সাথে পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটতে থাকে ।

এক পর্যায়ে ঘোষণা করা হয় এরপর আর কোন কপ্টার আসবেনা । অথচ হেলিকপ্টারে থাকা সিটের কয়েকগুণ যাত্রী সেসময় এ্যাম্বেসির আশেপাশে অবস্থান করছিলো। সেই যাত্রীদের মাঝে আমেরিকাপন্থী ভিয়েতনামীরা ছিলো , দক্ষিণ ভিয়েতনামের সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ছিলো আর আমেরিকান নাগরিক রা তো ছিলোই

ছবিতে দেখা যাচ্ছে এক আমেরিকান নাগরিক এক দক্ষিণ ভিয়েতনামী কে ধাক্কা দিয়ে হেলিকপ্টারে উঠার সিড়ি থেকে ফেলে দিচ্ছে । উদ্দেশ্য সাইগুন ছাড়ার শেষ হেলিকপ্টারে নিজের জন্য জায়গা করে নেওয়া । দক্ষিণ ভিয়েতনামীর ভাগ্যে কি ঘটেছিলো তা হয়তো কখনোই জানা যাবে না । ওই আমেরিকান শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরে যেতে পেরিছিলো কি না তাও জানা যাবে না ।

কত জিনিস আমাদের অজানা থেকে যায় ।

এইটা আর এমন কি!

__________

তালে বানরা ক্ষমতা দখলের পর কাবুল মুখী মানুষের স্রোত দেখা গেছে। কাবুলের পতনের পর এয়ারপোর্টে মানুষের ভীড় দেখা গেছে।প্লেনে উঠার প্রাণান্ত চেষ্টা করছে মানুষ। অনেকের মতেই এটা ভিয়েতনামের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।

বাস্তব সত্য হচ্ছে তালে বানরা ক্ষমতা দখলের পর অনেকেই আফগানিস্তান ছাড়তে চাইছেন। রেকর্ড সংখ্যক মানুষ তুরস্কে ঢুকার চেষ্টা করছেন।

কিন্ত কেন?

___________

১৯৯৫ থেকে ২০০১ এর সময়কাল যদি ফিরে তাকানো যায়..ওই সময় তালেবানরা ব্যাপক মাত্রায় উগ্র এবং অসহনশীল আচরণের পরিচয় দিয়েছে। তাদের আচরণে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব ছিলো৷

ক্ষমতা দখলের সময় আফগানিস্তানের সেই সময়ের প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘ কম্পাউন্ডে আশ্র‍য় নেন। তালে বান যোদ্ধারা তাকে সেই জাতিসংঘ কম্পাউন্ড থেকে টেনে হেঁছড়ে বের করে এনে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। তাঁর লাশ গাড়ির পেছনে আটকে পুরো শহর ঘুরানো হয়। সেই মৃত দেহ বিকৃত করা হয়।

অথচ ইসলামেই মৃতদেহের সাথে নৃশংস আচরণ করার ব্যাপারে নিষেধ আছে।

এছাড়া নারী শিক্ষা নিষিদ্ধ করা । ফুটবল, দাবা সহ অন্যান্য খেলাও ব্যান করা হয়। নারীদের ঘরের বাইরে বের হবার ক্ষেত্রে একজন পুরুষ সংগী ( অবশ্যই আত্মীয়) এর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। টেলিভিশন, গান সহ বিনোদন এর সব মাধ্যম বন্ধ করা হয়। ছবি তোলা নিষিদ্ধ করা হয়৷

এসবের পেছনে যুক্তি হিসেবে শরিয়া আইনের প্রয়োগ দেখানো হয়। কিন্ত বিভিন্ন বিশ্লেষকের মতে এসব আইনের প্রয়োগ অনেক জায়গাতেই পশতুন সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলো।

তালে বানদের নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা জটিল ছিলো। তবে তাদের একটা কাউন্সিল ছিলো যেটা খুব সম্ভবত লয়া জিরগা নামে পরিচিত। শুরুর দিকে মোল্লা ওমর এদের মতামতকে গুরুত্ব দিলেও পরে ইগ্নোর করা শুরু করেন।ল্যা জিরগা ওসামা বিন লাদেনকে আফগানিস্তান থেকে তাড়িয়ে দেবার ব্যাপারে মতামত দিয়েছিলেন। মোল্লা ওমর সেটা মেনে নেননি।

তালে বানরা ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে আগ্রহী ছিলো না। প্রায় ৬০ ভাগ অন্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের বঞ্চিত করে তারা সব জায়গায় পশতুন লোকদের বসাচ্ছিলো। সেটা সেই দায়িত্ব পালন করার জন্য তার যোগ্যতা থাকুক আর নাই থাকুক।

কূটনৈতিক দিক দিয়েও তালে বানরা ছিলো ভয়াবহ এক রোখা।

গত ২০ বছরে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে।

তালে বানদের নেতৃত্বেও পরিবর্তন এসেছে। তালে বানরা এখন কুটনীতি নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তারা বুঝতে পারছে অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে হলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জরুরি।কাবুল দখলের ক্ষেত্রেও তালেবানরা ধৈর্য্য এর পরিচয় দিয়েছে৷ গতবারের মতো এখনো কাউকে “ঝুলানো”র খবর পাওয়া যায়নি।

তালে বান মুখপাত্র জানাচ্ছেন মেয়েদের পড়াশুনা আর কাজের ব্যাপারে কোন বিধি নিষেধ আরোপ করা হবে না। শুধু ইসলামিক নিয়মে পর্দা মেইন্টেন করলেই হবে।

এগুলোর কতোটুকু বাস্তব সেটা সময় বলে দিবে।

লেখকঃ মুস্তাক হাসান
শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়