ইসরাইল স্থাপিত হয় কিভাবে?

ম্যাপে ইসরায়েল, পশ্চিম তীর এবং গাজার অবস্থান

জেরুজালেম শহরে একটা ছোট পাহাড় আছে যার নাম জায়োন। জায়োন পাহাড় আগেকার দিনে মেইন জেরুজালেম শহরের (আজ যাকে ওল্ড জেরুজালেম বলে) জাস্ট বাইরে ছিল। এই পাহাড় দেখে বুঝতে পারত মানুষ যে জেরুজালেমে এসেছিল।

ঈসা (আঃ) এর জন্মের প্রাই ৭০-৮০ বছর আগে ইহুদিদের নিজস্ব রাষ্ট্র ধ্বংস করে দেয় রোমানরা। সত্য বলতে কখনই বেশিদিন তাদের হাতে এই এলাকা ছিলনা। কয়েক দশকের মধ্যেই হারিয়ে ফেলত এই এলাকা যাকে কুরআন বলেন আর্দুল মুকাদ্দাসা (পবিত্র ভুমি)। এই কারনে অনেক অনেক বছর ইহুদিদের বিশ্বাস হয়ে ওঠে যে একদিন তাদের মেসায়াহ আসবে, এবং এই মেসায়াহ তাদের কে “প্রমিজড ল্যান্ড” এ নিয়ে যাবেন। মুসলিম ও খ্রিস্টান বিশ্বাসে মেসায়াহ (আরবিতে মাসিহ) হচ্ছেন ঈসা (আঃ) কিন্তু ইহুদিরা নবী ঈসা (আঃ) কে অস্বিকার করে।

এর পর প্রায় ১৮০০ বছর পর, ইউরোপিয় ইহুদিদের মধ্যে কিছু গ্রুপ বলা শুরু করে যে মেসায়াহ লাগবেনা আমরা নিজেরাই হলি ল্যান্ডে যেতে পারি। ওই সময়কার ইহুদি র‍্যাবাইরা (ওদের আলিম) এতই আতংকিত হয়েছিল এই জিনিস দেখে যে তাদের প্রতিদিনের দুয়া থেকে হলি ল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার দুয়া মুছে ফেলে। কিন্তু এই মুভমেন্ট যার নাম জায়োনিজাম দেয়া হয় আস্তে আস্তে বেগ পেতে থাকে। থিওডর হার্জেল নামে এক ইহুদি ১৮৯৭ সালে প্রথম জায়োনিস্ট কংগ্রেস অনুষ্ঠিত করে সুইজারল্যান্ডে।

জায়োনিজাম এর প্রতি সব চেয়ে বেশি এট্র‍্যাক্টেড ছিল ইউরোপ ও রাশিয়ার ইহুদিরা। আমেরিকান, আরব, আফ্রিকান ইহুদিদের ওই সময় তেমন উৎসাহ ছিলনা এর প্রতি। কিন্তু ইউরোপে বেশ নির্যাতন ও এন্টি-সেমিটিজাম এর কারনে তারা নিজেদের একটা দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চায়। প্রথমে যে কোন রাষ্ট্র হলেই হবে বলে ম্যাডাগ্যাস্কার এবং উগান্ডার কথাও উঠে। কিন্তু এদের মধ্যে সব চেয়ে উগ্র গ্রুপের কথস একটাই – আমাদের ঐতিহাসিক দেশেই ফিরে যাব।

এখানে একটু বলা দরকার যে ইউরোপিয়ান ইহুদি অনেকেই তেমন ধর্ম পালন করতেন না। তাদের ইহুদি হওয়া শুধু একটা ধর্মের কথা না, বর্নেরও ব্যাপার। তাই এখনো ইসরাইলি রা ইহুদি বনাম মুসলিম বলেনা, ইহুদি বনাম আরব বলে শুধু। তাদের কাছে এটা একটা জাতীয়তাবাদি ব্যাপার ও, শুধু ধর্মিয় নয়। ১৮৮২তে রাশিয়ান কিছু ইহুদি ফিলিস্তিনে মাইগ্রেট করলে ফার্স্ট ট্রু মাইগ্রেশান শুরু হয়। এই সময়, রাশিয়ার পুর্ব দিকেও একটা জায়গা কে নাম দেয়া হয় – জিয়ুইস ওটোনোমাস ওব্লাস্ট – যেটা আজ পর্যন্ত চীনের সিমান্তে আছে এবং ইসরাইল ব্যাতিত আরেকটা ইহুদিদের রাষ্ট্র হিসেবে আছে রাশিয়ার অধিনে (যদিও এখন মাত্র ১০০০+ ইহুদি আছে, বাকি সিবাই ইসরাইলে)।

১৯ শতাব্দির পর হাজারে হাজারে জায়োনিস্টরা ফিলিস্তিনে যেতে থাকে। অনেক ধনি ইহুদি, ও তাদের ফাইন্যান্সিং এ হাজার হাজার জায়োনিস্ট ফিলিস্তিনে জায়গা-জমি কেনা শুরু করে। এই সময় ছিল অটোমান আমলের শেষ কিছু বছর। এমনিও শেষ দুই শত বছর ধর্মের দিকে নজর চলে যাওয়ায় এবং আরব জাতীয়তাবাদি আসার কারনে আরবদের মধ্যেও অটোমানদের প্রতি একটা নেগেটিভ ফিলিং কাজ করে। অটোমানরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একদম সেই একটা ব্যাম্বু খাওয়ার পর ফিলিস্তিন হস্তান্তর করে ব্রিটিশদের কাছে। কিন্তু এখানেই সমস্যা শুরু।

রাশিয়ান এক ইহুদি, শাইম ওয়াইজমেন অনেক লবিং করা শুরু করে ব্রিটিশদের যাতে একটা ইহুদি রাষ্ট্রের ঘোষনা দেয়। ১৯১৭ সালে বালফুর ডিক্লেরেশানে বলা হয় যে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্যে একটা নিজের দেশ করা হবে, কিন্তু সবাই শান্তিতে থাকতে পারবে এমন একটা সলিউশান হবে (টপিক্যাল ব্রিটিশ ভন্ডামি)। এই ডিক্লারেশান এবং তুর্কিদের থেকে ফিলিস্তিন ব্রিটিশদের হাতে আসার পর জায়োনিস্টরা হাজারে হাজারে ইমিগ্রেট করে ফিলিস্তিনে। ব্রিটিশরা এনকারেজ ও করে।

স্বাভাবিকভাবেই, এক গোষ্ঠী ১০% থেকে ৩০% হয়ে যাওয়া দেখে লোকাল মানুষজনের এটা ভাল লাগেনাই। তাছাড়া ইসলামের চেয়েও ফিলিস্তিনিদের ওই সময় কাজ করছিল আরব জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদী দুই গ্রুপের রেশা রেশিতে বেশ কয়েকবার তান্ডব হয় – ১৯২০,২১,২৩ ইত্যাদি। ১৯২০ থেকে জায়োনিস্টরা অফিসিয়ালি নিজেদের একটা প্যারামিলিটারি ফোর্স তৈরি করে। জিয়ুইস এজেন্সির ব্যানারে হাগানাহ ফর্স তৈরি হয়। যদিও এদের প্যারামিলিটারি বলা হয়, এরা আসলে ছিল গুন্ডা। আরো কিছু জিয়োনিস্ট জংগি সংগঠন ও তৈরি হয়। আরবরা ওই সময় অনেক সাফার করে।

এর পর ১৯৩৬-৩৯ এ আরবরা মুক্তিযুদ্ধ করার চেষ্টা করে ব্রিটেন এর বিরুদ্ধে। ওই রেবেলিয়ান কে ব্রিটিশরা দমন করে অনেকটার হাগানাহর সাহায্যে। কিন্তু এর পর ১৯৩৯ এ ব্রিটিশরা সমস্যা কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাওয়ায় বলে যে ইহুদিদের ইমিগ্রেশান এখন থামাতে হবে। ১৯১৭তে তারাই আশ্বাস দিয়েছিল যে ইহুদিদের একটা নিকের দেশ গড়ে তুলবে ফিলিস্তিনে, এখন তারাই আবার বলে না আর আসবেনা। এমন সময় হাগানাহ ও জিয়ুইস এজেন্সি খেপে যায়।

তারা ডাইরেক্ট জংগি কার্যক্রম শুরু করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। এমন কি জেরুজালেমের কিং ড্যাভিড হোটেলেও বোমা মেরেছিল ব্রিটিশ মেইন অফিসে। বিভিন্ন সময় হাগানাহ ও অন্যান্য জায়োনিস্ট প্যারামিলিটারি গুলো আরবদের ও আক্রমন করত, ভয় দেখাত। দ্বীতিয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায়, এবং হিটলারের ইহুদি হত্যা শুরু হওয়ায়, নন-জায়োনিস্ট অনেক ইহুদিরাও জায়োনিস্ট হওয়া শুরু করে। হাগানাহ একদিকে ব্রিটিশদের আক্রমন করে আবার উলটা দিকে ওদের একটা ফর্স বিশ্ব যুদ্ধে ব্রিটিশদের সাহায্য করে। হাগানাহ অবৈধভাবে মাটির নিচে গুলির ফ্যাক্ট্রি তৈরি করেছিল। এই জংগি কর্মকান্ডে একদম শীর্ষে ছিল ড্যাভিড বেন গুরিয়ন, যে পরে হয়ে যায় ইসরাইলের প্রথম প্রধান মন্ত্রী। আরো দুইজন জংগী, য়িটশাক শামির ও মেনাশিম বেগিন ও পরে প্রধান মন্ত্রী হয়েছিল।

১৯৪৭ আসতে আসতে, ফিলিস্তিনের অবস্থা খুব বাজে। শত শত বছর পাশাপাশি থাকা তিন ধর্মের মানুষ এখন যুদ্ধ-অবস্থা প্রায়। মুসলিম ও খ্রিস্টান আরব একদিকে, জায়োনিস্ট ইহুদি একদিকে। এমন সময় ব্রিটিশরা একটা পার্টিশান চায়। বেশ কিছু আইডিয়া ফেলে দেবার পর, জাতিসংঘ একটা প্রস্তাব দেয় – ফিলিস্তিন কে ভাগ করা হবে।

৫৫% হবে ইসরাইল, ৪৫% হবে ফিলিস্তিন এবং জেরুজালেম হবে একটা “আন্তর্জাতিক শহর”। এটা চোখে ভাল দেখালেও এই প্রস্তাবে ইনসাফ ছিলনা। ৫৫% জায়গা পাচ্ছিল যারা, তারা ছিল মাত্র ৩৩% জনসংখ্যা, এবং অধিকাংশ ছিল রেফিউজি ও ইমিগ্রেন্ট। জায়োনিস্টরা মেনে নিলেও, আরবরা মানে নাই। শুরু হয় প্রথম যুদ্ধ যেখানে হয় নাকবা – সর্বনাশ।

৮০% ফিলিস্তিনি আরব, প্রায় ৭.৫ লাখ মানুষ কে তাদের ঘরবাড়ি থেকে তাড়ানো হয়। এরা ও এদের বংস আজ পর্যন্ত রেফিউজি। যুদ্ধ লেগে গেলে, গাজার অংশ দখল করে মিসর, পশ্চিম তির ও জেরুজালেমের আল-আকসা দখল করে জর্ডান।

৪৮ এর নাকবাহ থেকেই শুরু ইসরাইলের যাত্রা। আরেকদিন ৪৮ থেকে আজ পর্যন্ত ইসরাইল কিভাবে টিকে আছে, কতগুলো যুদ্ধ হয়েছে এবং শান্তিচুক্তি কেন ফেইল করেছে তা নিয়ে কথা বলব।

লেখকঃ ডাক্তার
Undergraduate Clinical Supervisor at University of Cambridge